শিক্ষক হতে হলে মেধা, পরীক্ষার ফলাফল, না ভাগ্য-কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আমরা যেভাবে ভাবি, মানুষকে ভাবাই সেভাবে। মেধাবী একজন মানুষ মনে করে, পরীক্ষার ফলটাই বড়। তখন সে হার মেনে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইটা থামিয়ে দেয়, হতাশ হতে হতে পিছিয়ে পড়ে। পরীক্ষার তথাকথিত ফলাফলের নিচে এভাবে নীরবে-নিভৃতে মেধাবী মুখগুলো চাপা পড়ে যায়, দেশ হারায় প্রকৃত মেধাবী মানুষদের। আর রেজাল্টসর্বস্ব মানুষদের নিয়ে মেতে ওঠে গোটা সমাজ।
মেধা আর পরীক্ষার ফল এক নয়। মুখস্থ বিদ্যা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এক নয়। মানুষকে বিচার করা উচিত তার মেধা দিয়ে, পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে নয়। পরীক্ষার ফল যারা ভালো করে, আমরা তাদের স্বপ্ন দেখাই। এতে দোষ নেই। তবে যারা মেধাবী, কিন্তু পরীক্ষার ফল ভালো নয়, তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিই। এটি অপরাধ।
এখন চাকরি থেকে শুরু করে সবখানেই পরীক্ষার ফলকে মেধা যাচাইয়ের মানদণ্ড হিসাবে ধরা হচ্ছে, এটা অনুচিত। কিন্তু সমাজ তো আমার কথাগুলো উলটো করেই ভাববে, কারণ সমাজ যে উলটো পথেই হাঁটছে। সত্যকে ভাবছে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য; কিংবা সত্যের ভেতরে মিথ্যা, মিথ্যার ভেতরে সত্যকে ঢুকিয়ে হাত-পা ছেড়ে বসে আছে। অদ্ভুত এক সমাজতত্ত্ব, যা মনস্তত্ত্বকেও খেয়ে ফেলছে।
শিক্ষায় পরীক্ষার ফলের চেয়ে মেধা যাচাই যখন মানদণ্ড হিসাবে কাজ করবে, তখনই শিক্ষা পূর্ণতা অর্জন করবে। খণ্ডিত শিক্ষার চেয়ে মেধাভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার প্রচলন করলেই মেধাবীদের স্বপ্ন জিইয়ে রাখা যাবে। তা না হলে মাথা বাড়বে, মাথার ভেতর থেকে নতুন জ্ঞান বেরিয়ে আসবে না। মেধার মূল্যায়ন না হলে পৃথিবী হারাবে আইনস্টাইন, নিউটন, টমাস আলভা এডিসন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলদের।
মমতাময়ী মাও তো একজন শিক্ষক। সেটা আমরা হয়তো বুঝতে পারি না। তবে সময় আমাদের তা বুঝিয়ে দেয়। একটা ঘটনায় বিষয়টি অনেক সহজবোধ্য হয়ে যাবে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। একদিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে খামবন্দি চিঠি দিলেন। তিনি মাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন : ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ মায়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। একদিন তার পারিবারিক পুরোনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল ‘আপনার সন্তান মেধাহীন ও নিু বুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’
এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং তার চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে ভেবেছেন কীভাবে একটা নেতিবাচক ধারণাকে ইতিবাচক ধারণায় পরিণত করা যায়। তিনি এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে যেতে দেননি, বরং তার মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন যে, তার মতো মেধাবী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কয়েকটি শব্দের ইতিবাচক পরিবর্তন এডিসনের জীবন পালটে দিয়েছিল। এখানে এডিসনের মা একজন শিক্ষকের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরা তা পারেননি।
ঠিক একই কাজটা আমরা করি, তরুণ প্রজন্মকে আমরা পরীক্ষার খাতার নম্বর দিয়ে মূল্যায়ন করি, তাদের ভেতরের মৌলিক ভাবনাকে বের করে আনার চেষ্টা করি না। কারণ আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে তা নেই। যে যেভাবে পেরেছে, তরুণদের গিনিপিগ বানিয়ে তাদের ওপর শিক্ষার বোঝা সেভাবে চাপিয়েছে; কিন্তু তরুণদের মেধা দিয়ে নতুন শিক্ষার উদ্ভাবনকে বারবার অবজ্ঞা করেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, যে তরুণটাকে আমরা সবচেয়ে খারাপ ছাত্র বলে বিবেচনা করছি, মেধাভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন থাকলে সে-ই হয়তো সবার প্রথমে থাকত, উলটোদিকে যে এখন প্রথমে আছে সে হয়তো পেছনে থাকত। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই।
সব বিখ্যাতই ভালো ছাত্র নয়, কিন্তু মেধাবী। মেধাবী আর ভালো ছাত্র আমরা সব সময় গুলিয়ে ফেলি। মেধাবীদের প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেছেন, তারা সব সময় ছকের বাইরে চিন্তা করেন, তারা বইয়ের পোকা নন, তারা আত্ম-শিক্ষণে বিশ্বাসী, তারা কারও অধীনে থাকতে পছন্দ করেন না, তারা গ্রেড সিস্টেমে নিজেদের যোগ্যতা পরিমাপ করেন না, সফলতাকে তারা ভিন্নভাবে পরিমাপ করেন, তারা রুটিন অনুসরণ করতে পছন্দ করেন না, লক্ষ্য পূরণের অনুভূতি তাদের জীবনে তাড়াতাড়ি আসে, তারা ঝুঁকি গ্রহণকারী, তারা স্বপ্নবাজ হয়ে থাকেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের ভেতরের এ আচরণগুলোকে কখনো কি বিশ্লেষণ করে দেখেছে? আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘যারা মাত্রাতিরিক্ত বই পড়েন এবং নিজের মস্তিষ্ককে কম কাজে লাগান, তাদের চিন্তাভাবনার অভ্যাসে মূলত অলসতা চলে আসে।’ খুব অন্তর্নিহিত একটা দর্শন। চিরায়ত ধারণার সঙ্গে যেটাকে ভিন্ন বলে মনে হতে পারে।
তবে কথাটার অনেক ওজন আছে, আবার তর্ক-বিতর্কের মতো জায়গাও আছে। বই মানুষকে কখনো কখনো তার নিজের মৌলিক চিন্তা থেকে সরিয়ে দেয়। বই যে পর্যন্ত মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে পর্যন্ত পড়া ভালো। তবে বই যদি মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে তার চিন্তার জায়গায় বইয়ের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়, তাহলে মানুষ স্বকীয় চিন্তা হারিয়ে বইয়ের মধ্যে আবদ্ধ চিন্তার কাছে পরাধীন হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, কোনো একজন মানুষের চিন্তা কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বইয়ের জন্ম দেয়। এভাবে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন অসংখ্য বইয়ের জন্ম দেয়। কারও সঙ্গে কারও লেখার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আবার সময় যত গড়িয়েছে, লেখার ধরনেও তত পরিবর্তন ঘটেছে। যেটা প্রমাণ করছে, লেখকরা প্রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মৌলিকত্বের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তরুণরা বই পড়বে, তবে বইয়ের মতো করে ভাববে না, বরং নিজের মতো করে ভাবনা তৈরি করে বইয়ের ভেতরের ভাবনা বদলে দেবে কিংবা বিকশিত করবে। কারণ নতুন চিন্তার জন্ম না হলে নতুন গবেষণার পথ তৈরি হয় না। অতি পরনির্ভরতা মানুষের নিজের ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে দেয়।
বইয়ের মতো মহামূল্যবান বিষয় এখানে একটা উপমামাত্র। এমন অনেক বিষয়ের কাছে আমাদের তরুণরা তাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে হারিয়ে পরাধীনতাকে বেছে নিচ্ছে। বইয়ের মতো একটা ইতিবাচক জিনিসের মধ্যে এমন নেতিবাচকতা খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে থাকলে অনেক ইতিবাচক বিষয়ের মধ্যেই তেমনটা থাকার কথা। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না’ কিংবা দেকার্তের ‘ভালো বই পড়া যেন গত শতকের মহৎ লোকের সঙ্গে আলাপ করার মতো’ উক্তিগুলো আইনস্টাইনের ভাবনার সঙ্গে কতটা সমীকরণ তৈরি করতে পারছে, সেটা না হয় গবেষণার বিষয়বস্তুই হয়ে থাক। কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকা ভালো।
আবুল মনসুর আহমদের ‘আদু ভাই’-এর কথা মনে পড়ছে। গতানুগতিক শিক্ষার অচলায়তন ভাঙতে পারেননি তিনি। সবাই মনে করেন, আদু ভাই মানে পরীক্ষায় ফেল করা একজন ব্যর্থ মানুষ। কিন্তু আদু ভাই শিক্ষার বোঝা মাথায় নিয়ে বুঝিয়েছেন, মুখস্থকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা একসময় মানুষের মাথাকে খেতে খেতে মানুষকে রোগী বানায়, কখনো কখনো মৃত্যুও ডেকে আনে। নিজের মাথাটা দেহের ভেতর ঢুকিয়ে যদি সত্যকে বের করে আনা যায়, তখন হয়তো বুঝতে বাকি থাকবে না ব্যর্থ আদু ভাই ছিলেন না, ব্যর্থ ছিল এ সমাজ। যেখানে শিক্ষার ভারে নুয়ে পড়া মানুষটা তার ভেতরে সুপ্ত হয়ে থাকা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দ উদ্যাপন করতে পারেনি। নিজের স্বপ্নটা শিক্ষার স্বপ্ন হয়ে আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
আদু ভাইয়ের ছেলে গল্পের একপর্যায়ে এসে বলছে, “প্রমোশনের জন্য তিনি এবার দিনরাত এমন পড়াশোনা শুরু করেছিলেন যে, শয্যা নিলেন তবু পড়া ছাড়লেন না। আমরা সবাই তার জীবন সম্বন্ধে ভয় পেলাম। পাড়াশুদ্ধ লোক গিয়ে হেডমাস্টারকে ধরায় তিনি স্বয়ং এসে বাবাকে প্রমোশনের আশ্বাস দিলেন। বাবা অসুখ নিয়েই পালকি চড়ে স্কুলে গিয়ে শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিলেন ও আগের কথামতো তাকে প্রমোশন দেওয়া হলো। তিনি তার ‘প্রমোশন-উৎসব’ উদ্যাপন করার জন্য আমাকে হুকুম দিলেন। কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে, তার লিস্টও তিনি নিজ হাতে করে দিলেন। কিন্তু সেই উৎসবে যারা যোগ দিতে এলেন, তারা সবাই তার জানাজা পড়ে বাড়ি ফিরলেন।
আমি চোখের পানি মুছে কবরের কাছে যেতে চাইলাম।
ছেলে আমাকে গোরস্তানে নিয়ে গেল। দেখলাম, আদু ভাইর কবরে খোদাই করা মার্বেল পাথরের টেবলেটে লেখা রয়েছে : Here sleeps Adu Mia who was promoted from Class VII to Class VIII.
ছেলে বলল : বাবার শেষ ইচ্ছামতোই ও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
কী আছে এমন শিক্ষায় যেখানে মার্বেল পাথরে লেখা আছে কীর্তির কথা, অথচ সে কীর্তির ভ্রান্ত পথে ছুটতে গিয়ে মানুষটাই আর বেঁচে নেই? ঠিক তেমনই কী আছে দামি কাগজের ওপর খোদাই করা সার্টিফিকেটের, যা তরুণদের ভেতরে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা সম্ভাবনাকে থামিয়ে দিয়ে বেকার বানাচ্ছে, মেধাকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত করছে?
একজন মানুষের কথা বলব। না, ঠিক আবুল মনসুর আহমদের আদু ভাই নয়, তিনি জ্যাক মা, যিনি ফেলের পর ফেল করেছেন, একটার পর একটা চাকরির ভাইভা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু নিজের মেধাকে কখনো হারিয়ে ফেলেননি, স্বপ্নকে কখনো মরতে দেননি। গণিতে মাত্র ১ মার্ক পেয়েছেন; কিন্তু মেধা দিয়ে নতুন ভাবনা তৈরিতে ১০০তে ১০০ পেয়েছেন। থেমে যাননি, সমাজের বাঁকা চোখে নিজেকে গুটিয়ে নেননি বরং পুঁজিবিহীন আলীবাবার মতো ব্যবসা গড়ে তুলে সারা পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে শিক্ষা নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেটি প্রকৃত শিক্ষা নয়। এর থেকেও আরও অনেক বড় জিনিস শিক্ষা, যেখানে পরীক্ষায় পাশ-ফেলের চেয়ে মেধার মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষা তখনই সফল, যখন তা মেধার জন্ম দেয়; শিক্ষা তখনই বিফল, যখন তা মানুষকে রোবট বানায়। এমন মৌলিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে আমরা কি পারব শিক্ষার প্রকৃত রূপটি বের করে আনতে?
যে তরুণরা পরীক্ষায় পেছনে পড়ে যাচ্ছে, তাদের স্বপ্ন দেখানোর পরিবর্তে আমরা আরও তাদের মন ভেঙে দিচ্ছি, তিরস্কার করছি। অপরাধ না করেও সমাজের কাছে তারা কেবল পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর পাওয়ার কারণে বিব্রত হচ্ছে। খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে বলে মুখ লুকাচ্ছে, নিজের কাছে নিজেকে বারবার ছোট মনে হচ্ছে তাদের। তখন স্বপ্ন, সাফল্য ও সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। বরফ জমাট বাঁধছে, না পারার যন্ত্রণাটা সেখানে অস্থির হয়ে আটকে পড়ছে।
সবকিছু ঝুলন্ত মনে হচ্ছে, আমাদের মেধাবী তরুণরাও ঝুলে আছে মাকড়সার মতো। তাদের আবার নতুন করে পথ দেখাতে পারব তো আমরা? কারণ সবচেয়ে বড় সাহসের নাম স্বপ্ন দেখানো।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
মন্তব্য করুন