রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ডেঙ্গিজ্বর কখন মারাত্মক হয়

ডা. মনজুর হোসেন
  ২৪ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৮

বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই দেখা দেয় ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব। কখনো কখনো এ জ্বর মহামারিরূপেও দেখা দেয়। এ বছর দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ আবার বেড়েছে। সারা দেশে মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্ক। বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ গত ৫০ বছরে ৩০ গুণ বেড়েছে।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও আটজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে দেশে চলতি বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮৩-তে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে এ ভাইরাল জ্বরে সারা দেশে আরও ৭৬৫ জন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে এক বছরে ২০ হাজারের বেশি ডেঙ্গি কেস রেকর্ড হয়েছে।

২০২২ সালে রিপোর্ট করা ২০ হাজার ২৩৫-এর বেশি ডেঙ্গু কেস এখন পর্যন্ত ২০০০ সালে প্রথম কেস রিপোর্ট হওয়ার পর থেকে এক বছরে রিপোর্ট করা তৃতীয় সর্বাধিক কেস (শুধু ২০১৯ সালে দেশে ১ লাখ ১ হাজারের বেশি কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল)।

ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশাবাহিত এক ধরনের তীব্র ভাইরাস জ্বর। ডেঙ্গু দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা ছড়ায়। এর একটি হচ্ছে এডিস এজিপটাই ও অন্যটি এডিস এলকোপিপটাস। এডিস মশা ডেঙ্গিজ্বরে সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড় দেওয়ার পর ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস বহন করা সেই মশা যখন কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দেয় তখন ওই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এডিস মশা দিনে কামড়ায়। এই মশা ডিম পাড়ে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পাত্রে জমে থাকা পানিতে; যেমন-ফুলদানি, ফুলের টব, হাঁড়ির ভাঙা অংশ, পরিত্যক্ত টায়ার, মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ডাবের খোসা ইত্যাদি।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চার ধরনের স্ট্রেইন আছে : ডেন (DEN) ১, ২, ৩ ও ৪। সংক্রমণ থেকে সুস্থতার পরে অন্যান্য সেরোটাইপের ক্রস-ইমিউনিটি শুধু আংশিক ও অস্থায়ী। অন্যান্য সেরোটাইপ দ্বারা পরবর্তী সংক্রমণ (সেকেন্ডারি ইনফেকশন) মারাত্মক ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যাদের শরীর এই স্ট্রেইনের বিপরীতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না, তারা বেশি সংক্রমিত হন।

শিশু-কিশোররা এ জ্বরে আক্রান্ত হয় বেশি। যদিও বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন বা হালকা লক্ষণ দেখা যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতায় রূপ নিতে পারে, যা শিশুদের ও প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুও ঘটাতে পারে। সংক্রমিত মশার কামড়ের ৪ থেকে ১০ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ডের পর সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন ধরে লক্ষণগুলো স্থায়ী হয়।

সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। শরীরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রা ছাড়াও আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন অত্যধিক পেটে ব্যথা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। বমি বমি ভাব হয়। রক্তনালি থেকে প্লাজমা বেরিয়ে যায় (রক্তের প্লাজমা লিকেজ) এবং প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে থাকে। ফুসফুস ও পেটে পানি জমে।

কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর যদি আরও জটিল অবস্থার দিকে যায়, তখন বিভিন্নভাবে রক্তক্ষরণ হয়। ডেঙ্গু শক হয়। ডেঙ্গি শক হলে যে উপসর্গগুলো সাধারণ হয় তা হলো রক্তচাপ কমে যাওয়া, রোগীর অচেতন হয়ে যাওয়া। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণের জন্য কালো দাগ পড়ে। কালো পায়খানা হয়। অনেক সময় প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত ঝরে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। লিভার, কিডনি ও হার্টের ক্রিয়া ক্ষমতা হ্রাস পায়।

তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুকে দুটি প্রধান বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ করেছে : সতর্কতা চিহ্নসহ বা ছাড়া ডেঙ্গি এবং গুরুতর ডেঙ্গু। সতর্কীকরণ চিহ্নসহ বা ছাড়া ডেঙ্গুর উপ-শ্রেণিবিন্যাসটি স্বাস্থ্য অনুশীলনকারীদের হাসপাতালে ভর্তির জন্য রোগীদের পরীক্ষা করতে সাহায্য করতে, নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে এবং আরও গুরুতর ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে করা হয়েছে।

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু: উচ্চমাত্রার জ্বর (৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড/১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং ২-৭ দিন জ্বরের সঙ্গে এই উপসর্গগুলোর মধ্যে দুটি থাকে : প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি ও গীড়ায় ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, ফুসকুড়ি।

মারাত্মক ডেঙ্গু : অসুস্থতা শুরু হওয়ার প্রায় ৩ থেকে ৭ দিন পর এবং জ্বর নেমে যাওয়ার পর রোগী গুরুতর পর্যায়ে চলে যেতে পারে, যাকে ক্রিটিক্যাল ফেজ বলা হয়। গুরুতর পর্যায়ে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময়ে রোগীর লক্ষণগুলোর আকস্মিক অবনতি হয়। এ সময়ে যখন রোগীর জ্বর কমে যায় (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড/১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে), তখন মারাত্মক ডেঙ্গির সঙ্গে সম্পর্কিত সতর্কীকরণ লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। গুরুতর ডেঙ্গি একটি মারাত্মক জটিল পর্যায়। এক্ষেত্রে প্লাজমা লিক হয়, ফুসফুস ও পেটে পানি জমে, শ্বাসকষ্ট হয় এবং গুরুতর রক্তপাত হতে পারে।

সতর্কতামূলক লক্ষণ : সাংঘাতিক পেটে ব্যথা, অবিরাম বমি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত, ক্লান্তি বা অবসাদ, অস্থিরতা, লিভার বৃদ্ধি, বমি বা মলে রক্ত।

জটিল পর্যায়ে রোগীর এ লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য, যাতে জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে যথাযথ চিকিৎসাসেবা প্রদান করা যায়। সুস্থতার পর্যায়েও নিবিড় পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা উচিত।

সংক্ষেপে, ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত কয়েক স্তরের হয়ে থাকে। যেমন-ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর, হেমোরেজিক ডেঙ্গিজ্বর (ডিএইচএফ) এবং ডেঙ্গি শক সিনড্রোম (ডিএসএস)। ডিএসএস হলো ডিএইচএফের পরের ধাপ এবং তা খুবই বিপজ্জনক। শরীরের ফ্লুইড বের হয়ে যাওয়ার কারণে হঠাৎ শকে মানুষ মারা যায়।

অতএব, জ্বর হলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রচুর ফ্লুইডজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ধরনের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তবে এসপিরিন, আইবুপ্রুফেন বা এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়।

রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করাতে হবে। মারাত্মক রোগীর ক্ষেত্রে পানিস্বল্পতা ও রক্তক্ষরণের চিকিৎসার জন্য আইভি স্যালাইন বা রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।

প্রতিরোধ : বাহক এডিস মশা দমন করাই ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো-বাসগৃহে ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে জমে থাকা পানি অপসারণ করা। দিনের বেলায় মশারি ব্যবহার করা। অর্থাৎ রোগ ছড়ানোর আগেই এডিস মশা নির্মূল করে ডেঙ্গিজ্বর প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। স্কুল-কলেজের ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ সচেতন হলে ভয়াবহ ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বৃষ্টির পানি জমে থাকলেই ভয়াবহরূপে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশের প্রায় সব স্থানেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ডিম রয়েছে। বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম গৃহীত হলে এসব ডিম ধ্বংস করা সম্ভব। প্রতিকূল পরিবেশে এসব ডিম সুপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে পারে। যখন বৃষ্টি পড়ে পানি জমতে শুরু করে, তখন ওই ডিম থেকে মশা বেরিয়ে আসে। এ পরিস্থিতি এড়াতে এখনই সারা দেশে ডেঙ্গুর সম্ভাব্য প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন : শিশু রোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন