বিপুল অর্থ কামাতে মেঘনার জলদস্যুদের নজর এখন নদীর বালুতে। রাতের আঁধারে ড্রেজার ভাসিয়ে তারা বালু কেটে (উত্তোলন করে) বিক্রি করছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা এবং চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার চর এলাকার মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের চলে এই মহোৎসব। স্থানীয়দের অভিযোগ, গুয়াগাছিয়ার নয়ন ও পিয়াসের নেতৃত্বে চলছে এই অপকর্ম। তারা বলেন, ‘এরা ছিলো নৌ-ডাকাত, জলদস্যু।’ চাঁদপুর মোহনপুর এলাকার একটি সংঘবদ্ধ চক্রও নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে। এছাড়া চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর, ইব্রাহিমপুর, সাখুয়া, হরিণা ও হাইমচর এলাকা দিয়ে নানা প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন এবং বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। অথচ চাঁদপুরের নদী হতে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করার প্রশাসনিক কোনো অনুমতি তথা বালুমহাল ইজারা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রলারে ডাকাতি, হত্যা এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ কিছু মামলাও আছে এদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে তারা আবার বের হয়ে এসে একই অপকর্ম করছে।
স্থানীয়রা ভয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও গোপনে প্রশাসনকে বালু তোলার বিষয়টি জানিয়েছেন। তাদের অনেকেই বলছেন, এভাবে নির্বিচারে বালু তুললে বর্ষা পরবর্তী নদীর দুই তীরের ফসলি জমি ভাঙ্গনের মুখে পড়ে বিলীন হয়ে যাবে।
নৌ-পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, এই ‘বালুখেকোদের’ প্রতিরোধ করতে গিয়ে গত ১৬ জুলাই তাদের সঙ্গে নৌ-পুলিশের গোলাগুলিও হয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেঘনার উত্তরপাড়ে গজারিয়া উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর, শিমুলিয়া, দত্তেরচর এবং মেঘনার দক্ষিণপাড়ে উত্তর মতলব উপজেলার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের বেলতলী, কালীবাজারসহ আশপাশের এলাকায় গত দুমাস ধরে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে বালু তুলছে স্থানীয় নয়ন ও পিয়াস চক্র।
স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মতলব উত্তর উপজেলার ছোট কালীবাজার এলাকায় দিনের বেলা নোঙ্গর করে রাখা আছে কয়েকটি ড্রেজার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নয়ন ও পিয়াসের নির্দেশে চলে এই ড্রেজারগুলো। রাতের বেলা কখনো নদীর একপাড়ে কখনো অন্য পাড়ে গিয়ে বালু উত্তোলন করে।
অভিযুক্ত নয়ন ও পিয়াসের সঙ্গে কথা বলার জন্যে একাধিকবার তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মতলব উত্তর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিল্লোল চাকমা বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। অবৈধ বালু উত্তোলনের কথা শুনেছি। বিস্তারিত বিষয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয় অবগত আছেন।’
মতলব উত্তর থানার ওসি মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, বেলতলী, কালীবাজার এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করার লক্ষ্যে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), থানার পুলিশ, নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা ছিলেন। একাধিক অভিযানে অনেককে আটকসহ একাধিক ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে।
গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহ বলেন, ‘গুয়াগাছিয়া নদী এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন করার কারণে কালীপুরায় বৈধভাবে ইজারা নেয়া বালু উত্তোলন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কারণ বৈধ বালু নিতে আসা বাল্কহেডগুলোকে জোর করে আটকে তাদের দিয়ে অবৈধ বালু বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে ওই চক্র। মতলব উত্তর থানা, উপজেলা প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা নিলে এই অবৈধ উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব।’
গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কোহিনুর আক্তার বলেন, গুয়াগাছিয়ায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, গত ৮ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত মোট তিনবার অভিযান চালানো হয়েছে। ৩টি মামলাও করা হয়েছে। কালীপুরা থেকে অভিযানে একটি বাল্কহেড জব্দ করাসহ ৪ জনকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
কোহিনুর আক্তার বলেন, ‘মেঘনায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে পাশের মতলব উত্তর উপজেলা এবং দাউদকান্দি উপজেলার ইউএনওর সঙ্গে কথা বলে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
জানতে চাইলে গজারিয়া নৌপুলিশের ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, মামলা, গ্রেপ্তার এবং তাদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। আগামী দিনগুলোতে প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
মন্তব্য করুন