অবশেষে পাওয়া গেছে ১১ বছরের মেয়েটিকে। কয়েক দিন ধরে মেয়েটির নিখোঁজ সংবাদে ছেয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। অসংখ্য মানুষের মনে উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা ভর করেছিল—মেয়েটি কোথায় গেল, কীভাবে হারাল, কী হলো তার, কোনো অঘটন ঘটেছে কি না?
মানুষ হিসেবে এই উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তাই স্বাভাবিক। কারণ, এমন মেয়ের মতো তো কারও না কারও সন্তান আছে বা বোন আছে। ফলে এভাবে কোনো বাচ্চা হারিয়ে গেলে আমাদের দুশ্চিন্তাই হয়। তা ছাড়া মেয়েটির মা ক্যানসারে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে সন্তান নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আরও বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে।
মনে আছে পরির মতো শিশু সেই মুনতাহার কথা? গত নভেম্বরে সিলেটের কানাইঘাটের পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার খোঁজে দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। অনেকে তার সন্ধানে স্বর্ণের চেইন উপহার, লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু হায়, বাড়ির পাশেই ডোবায় তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল।
যাক, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি নিরাপদেই ফিরে এসেছে, মানে তাকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী উদ্ধার করেছে। আজকে এর চেয়ে স্বস্তিদায়ক খবর আর কী হতে পারে।
কিন্তু যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য মানুষ তাকে নিরাপদে ফেরত পেতে উদ্গ্রীব ছিল, সেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই অনেক মানুষের আচরণ দেখে যে কারও মনে হতে পারে, মেয়েটিকে নিরাপদে বা জীবিত ফিরে এসেই বরং ‘অন্যায়’ করেছে। কারণ, মেয়েটি আসলে হারিয়ে যায়নি বরং পালিয়েছিল এক ছেলেবন্ধুর সঙ্গে, যাকে তার কথিত প্রেমিক বলে এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারছি।
ব্যস, এ বিষয় জানার পর গোটা দৃশ্যপটই যেন বদলে গেল। এই বয়সে একটা মেয়ে কীভাবে প্রেম করতে পারে, আবার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েও গেল? কী যুগ এল রে বাবা! বাসায় ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের কথা একটুও ভাবল না? আমাদের কালে আমরা এই এই এই করতাম আর এখনকার বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে প্রেম করে পালিয়ে যায়—এমন হাজারো প্রশ্নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জর্জরিত হচ্ছে মেয়েটি। রীতিমতো তাকে অপরাধের কাঠগড়ায় তুলে ফেলা হয়েছে।
আরও অবাক লাগে, অনেকে এ সুযোগে বাল্যবিয়ের যৌক্তিকতাও হাজির করছেন। তাঁরা সন্তান লালনপালন ও শিশুর বেড়ে ওঠায় নানা সংকটের সমাধান খুঁজছেন বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে যেন শিশুর পুতুল খেলা! কী হাস্যকর!
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ১১ বছরের একটি মেয়ে, বাচ্চা মেয়েই তো। এখনকার বাচ্চারা অনেক কিছুই বুঝে, কিন্তু পরিবার–সমাজ বা দুনিয়ার বাস্তবতা এবং প্রেম বা নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কতটুকুই–বা বোঝাপড়া থাকার কথা তার?
আর কৈশোর বা বয়ঃসন্ধির এই সময় যেকোনো বাচ্চার জন্য জটিল। এই বয়সেই তো বাচ্চারা ভুল করে। হাসতে খেলতে বা অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, তার বিপদ সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটির ক্ষেত্রেও সেটি ঘটেছে বলতেই হয়।
অন্যদিকে মায়ের দুরারোগ্য ব্যাধি, পরিবারের ওপর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এমন বাচ্চার প্রতি খেয়াল রাখার সুযোগই–বা কোথায়! তখন তো এমন অঘটন ঘটা একেবারেই অস্বাভাবিক না। মেয়েটি নিরাপদে ফিরে এসেছে, এটিই তো বড় আনন্দের বিষয় হওয়ার কথা। কিন্তু না, অনেক মানুষ তাকে নিয়ে বসিয়ে ফেলেছে সোশ্যাল ট্রায়াল। করছে ট্রল, বানাচ্ছে মিম। শুধু তা–ই নয়, নোংরা ও কুশ্রী ভাষায় তাকে আক্রমণও করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম থেকে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে, ওই কথিত প্রেমিক একজন তরুণ মানে প্রাপ্তবয়স্ক। তাহলে তো আইন ও সমাজের চোখে সে-ই এখানে একমাত্র দোষী বা অপরাধী হতে পারে। কারণ, এই বয়সে কোনো বাচ্চা নিজের কনসেন্ট বা সম্মতিতে কারও সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে না। কারও ইন্ধন, ফুসলানো, ফাঁদে ফেলা বা প্রতারণার বিষয়টিই এখানে বরং প্রাধান্য পায়।
এটিও বলতে হয়, মেয়েটিকে উদ্ধার করার সময় আমাদের কিছু সংবাদমাধ্যমকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ, তার বক্তব্য নেওয়ার বিষয়ে যেভাবে উদ্গ্রীব দেখা গেল, তা নিয়েও সমালোচনা উঠেছে। শিশু বা অল্পবয়সীদের বিষয়ে সাংবাদিকতা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
এখন আসি যুগের বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিশুসাহিত্যিক কাজী তাহমিনা, যিনি নিজে তিন কন্যার মা এবং প্যারেন্টিং নিয়ে লেখালিখি করেন, বলছেন—‘মানুষজন এত অবাক হচ্ছে, যেন তারা ১১/১২ বছর বয়সী কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেনি। আমরা যখন ছোট ছিলাম, সেই ২৫–৩০ বছর আগেও আমাদের স্কুলের সিক্সের বড় আপু, পাশের পাড়ার ক্লাস টেনপড়ুয়া ভাই একসঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। আমাদের গ্রামে এমন কত ঘটনা ঘটেছে। “প্রেম প্রীতি ভালোবাসা, দেওয়া নেওয়া মন” এসব আগেও ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।’
তথ্যপ্রযুক্তির কারণে শিশুদের নিয়ে এখনকার সময়ের যে বিপদ, সে বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও সচেতনতামূলক বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইমো-টিমোর বদৌলতে অল্প বয়সের এসব ভিমরতি এখন মহামারি হয়ে যাবে। তাই দোহাই লাগে বাচ্চাদের হাতে নিজস্ব স্মার্টফোন দেবেন না, আনঅ্যাটেন্ডেড নেট ব্যবহার করার সুযোগ দেবেন না। সংগত কারণে ফোন ব্যবহার করতে দিলেও খেয়াল রাখুন।’
‘বাচ্চাকে সময় দিন এবং কাদের সঙ্গে মেশে, কী পড়ে, কী দেখে, এগুলো খেয়াল রাখুন। বাচ্চাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িত রাখুন। খোলাখুলি কথা বলুন, গল্প করুন। খালি কোচিং, স্কুল, গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভর না করে নিজেও দু–একটা বিষয়ে পড়ান। ঘুরতে নিয়ে যান। বাচ্চাকে ভেবেচিন্তে কাজ করার ব্যাপারে ছোটবেলা থেকে উৎসাহিত করুন।’
কাজী তাহমিনা এত সুন্দর ও যথার্থভাবে ঘটনা ও বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেছেন, এটিই আসলে আমাদের সবার বোঝা দরকার বা উচিত বলে মনে করি।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে কীভাবে ফেলে যেতে পারল একটি মেয়ে? একটি সংবাদমাধ্যমকে মেয়েটি বলছে, তার ভালো লাগে না। এ জন্য সে পালিয়ে পরিবার থেকে পালিয়ে গেছে। আসুন, এবার আমাদের এক বন্ধু শৈলী আখন্দের অভিজ্ঞতার কথা শুনি।
তিনি বলছেন, ‘আমার বাবার যখন ক্যানসার ধরা পড়ে, আমিও তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। সপ্তম শ্রেণি থেকে আমার ইন্টার ফার্স্টইয়ার অবধি তিনি কেমোথেরাপি নিতেন। আমিও ১৩-১৪ বছর বয়সে এ রকম বারবার বাসা থেকে চলে যেতাম, বিভিন্ন পার্ক ও ফুটপাতে বসে থাকতাম। কারণ, বাসায় আমার দমবন্ধ লাগত।’
‘বাসার লোকজনকে আমি নিঃসন্দেহে ঝামেলায় ফেলতাম, এটি সত্যি; কিন্তু বয়ঃসন্ধি-কৈশোরে মানসিক একাকিত্ব কীভাবে পরিবার থেকে বাচ্চাদের দূরে ঠেলে দেয়, তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি নিজে। আমার বোনের সে সময় দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার স্কলারশিপ ছিল, সে দেশের বাইরে যেতে পারেনি; কারণ, সে সময় তাকে আমাদের পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিল।’
‘এখানে এ প্রশ্নও করতে পারি, ক্যানসারের মতন ব্যয়বহুল চিকিৎসায় এ রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব কী? কেন পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায়? কেন পরিবারগুলো মানসিকভাবে এত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়? সেই মানসিক স্বাস্থ্যের পুনর্বাসন কীভাবে হয়? রাষ্ট্রের কী ভূমিকা? আসলে, রাষ্ট্রের বদলে মানুষের দিকে আঙুল তুলতেই আমরা অভ্যস্ত।’
মেয়েটি নিশ্চয়ই তার ভুল বুঝতে পারছে বা পারবে। তবে বড় ধরনের মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্য দিয়েই তাকে যেতে হয়েছে এবং যেতে হবে। আসুন আমরা তাকে বাঁচতে দিই। সামনে গোটা জীবনটা, গোটা পৃথিবীটাই তো পড়ে আছে তার জন্য। নতুন করে সে তার নিজের পৃথিবী গুছিয়ে নিক।
অনেকেই বলছেন, মেয়েটির এই কাণ্ডের কারণে ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ে হারিয়ে গেলে কেউ এমন উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা দেখাবে না। খোঁজাখুঁজিও করবে না। তা কি হয় কখনো? মানুষ কি তা পারে কখনো? এমন কত ঘটনায় মানুষের এমন মনে হয়েছে, ঠিকই কেউ হারিয়ে গেলে বা কারও খোঁজ পাওয়া না গেলে মানুষ তার চিরায়ত স্বভাবে এগিয়ে এসেছে। বারবার আসবে। গভীর দুশ্চিন্তায় অপেক্ষা করবে—আহা, আমার বাচ্চাটা কবে ফিরবে ঘরে!
রাফসান গালিব। ই–মেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন