কেন জানি মনে হল আমি কিছু শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনগুলো পার করছি। এত হীনতা দীনতা, নৈরাজ্য নৈরাশ্য, বেদনা যন্ত্রণা চারদিকে--কোনো মানুষেরই প্রাপ্তি ও শান্তির পূর্ণতা নেই। সবকিছুতেই হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ। কারো কোনো সময় নেই সুস্থির হয়ে সুচিন্তা করার। দিন যায় ত্রস্তব্যস্ত, রাত যায় নির্ঘুম। কোথা দিয়ে কে কাকে কখন কতটুকু ভেঙে খেতে পারবে, সেই চিন্তায় ওঁৎ পেতে থাকে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র পৃথিবী যেন বসেছে দ্রুতগতির চালকবিহীন গন্তব্যহারা ট্রেনে।
খেয়াল করুন, মানুষ আজকাল আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। কথা বলতে গেলেই একটি উত্তেজিত মনোভাব তার চোখেমুখে ফুটে উঠে। মানুষ হাসে জোর করে--প্রাণখুলে নয়, বুদ্ধি খেলে। কীসের জন্য যেন সদাব্যস্ত সবাই। অর্থসম্পদ? ভবিষ্যৎ-ভাবনা? মোটকথা, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি আছে কোনো না কোনোভাবে, কমবেশি সবারই। কারো বিষয় বা আশয় ভিত্তিক, ক্ষণিক কিংবা সার্বক্ষণিক, কখনো ব্যক্তিগত নয়তো সমষ্টিগত, প্রকাশ্য কি নীরব। মানবসমাজে শুধু নয়, বায়ুমণ্ডলে জঙ্গলে জলধিতেও দেখবেন প্রাণিদের মধ্যে কে কাকে খাবে, এই নিয়ে নিরন্তর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির ক্ষেত্রসমূহ কি কি?
পারিবারিক: এই যুগে নর-নারীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে রাখা এক দুরূহ সাধনা। মানুষ ‘আত্ম-বিবর্তনের’ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে সঙ্গীর মধ্যে কিছু একটার ঘাটতি পেলে বদলাতে চায়। সহজ যোগাযোগের কারণে খুঁজলেই সে বিকল্প পেয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা থাকে উদ্বিগ্ন: কে কখন কী করে বসে!
সামাজিক: সমাজে সহাবস্থানকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্তর্কলহ অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। আস্থা নির্ভরতা সহমর্মিতা ক্ষয়ে যাওয়ায় সামাজিক জীবনে অস্থিরতা আসছে। ব্যক্তিসম্পর্ক যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। মানুষ পেতে চায়, দিতে চায় না। নৈতিক অবক্ষয়, ভঙ্গুর সম্পর্ক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে করে রেখেছে বিচ্ছিন্ন। অপ্রাপ্তি অশান্তি দুরাশা হতাশা জীবনকে করে রেখেছে অস্থির চঞ্চল।
অর্থনৈতিক: ধনী গরিব সবার মধ্যে বিরাজ করছে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি--ভিন্ন ভিন্ন কারণে। ধনীদের টেনশন ধন ধরে রাখার, মধ্যবিত্তের উপরে উঠার এবং গরিবের বেঁচে থাকার। নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ছে, খাদ্য আবাসন স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যয় কমছে। প্রতিযোগিতা বেকারত্ব মূল্যস্ফীতি মানুষকে দৌড়ের উপর রাখছে।
সাংস্কৃতিক: প্রত্যেক জাতি তার খাদ্য পোশাক ভাষা ভাবনা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কে কার উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, সেই নিয়ে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা।
প্রযুক্তিগত: অসুস্থ বুদ্ধিযুদ্ধে প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে করায়ত্ত করে রাখার ভয়ানক প্রতিযোগিতার কবলে পড়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম হয়েছে। ডিজিটাল জীবনাচারের সাথে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্য।
শিক্ষাগত: অশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা মনমরা, দিশেহারা--জিজ্ঞাসা নেই মনে বা মুখে। কানে শুনে, মাথায়ও রাখে, হৃদয়ে ধারণ করে না। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, জ্ঞানী হচ্ছে না বলে তার চিত্তের অস্থিরতা যাচ্ছে না।
ব্যক্তিগত: সবার জীবনেই কিছু এলোমেলো বিশৃঙ্খলা আছে । শ্বাসরুদ্ধকর পারিপার্শ্বিকতা বিরাজ করছে নিজের কাজে, কর্মস্থলে, পরিবারে, স্বজনদের মধ্যে। শহুরে মানুষ আকাশ প্রকৃতি দেখতে না পেয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত কারণেও অনেকে অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই যেমন আমি। বারো বছর আগে অক্টোবরের এমন এক দিনে আমার ছেলেটা নাই হয়ে গেল--জীবনের মাধুর্য হয়ে উঠল কদর্য। অবসরে একাকিত্বে জীবনভাবনায় আপনারও নিশ্চয়ই মন খারাপ হয় কোনো এক কারণে।
মানসিক: ইদানীং জিঘাংসাপ্রবৃত্তি ও আত্মহত্যাপ্রবণতা বেড়েছে। অনেক অসুস্থ সন্তানের জন্ম হচ্ছে, অনেক দম্পতি নিঃসন্তান হয়ে পড়ছে এবং তরুণ-তরুণীরা অকৃতদার থাকছে। তাদের মানসিক অস্থিরতা বেড়ে চারপাশ অশান্তিময় হয়েেউঠছে।
ধর্মীয়: স্বধর্মী বা বিধর্মীদের মধ্যে অবিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস বাড়ছে। ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত জটিল করে তুলছে।
পরিবেশ: জলবায়ু সংকট এই গ্রহের ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলেছে। দোষণে দুষ্ট হয়ে পড়েছে সবকিছু--জল স্থল অন্তরীক্ষের জীব ও জড়। বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণে আপনার ফুসফুস বা রক্তচাপের অবস্থাও সঙ্গিন। খরা ও গরমের প্রভাবে তুচ্ছ নগণ্য কারণে অপরাধ অস্থিরতা রাগ ক্ষোভ সহিংসতা বাড়ছে।
কারণ কি এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির? মুখ্য কারণ হল মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, অফুরান অতৃপ্তি, অশেষ প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও স্বীকৃতির সীমাবদ্ধতা, সীমাহীন লোভ, অদম্য অহমিকা, তুলনামূলক প্রদর্শনী, প্রযুক্তির আসক্তি, হুমড়ি খাওয়ার প্রবণতা, জনাধিক্য, বেকারত্ব।
সমস্যা কি এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির জন্য? বিশ্বাস কমে, নিঃসঙ্গতা বাড়ে। মানুষের স্বচ্ছ স্বাভাবিক চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। বিকৃতির বিস্তার ঘটে। ছোট ঘটনা আকস্মিক তোলপাড় সৃষ্টি করে। অনিষ্ট অসুস্থ অদরকারী প্রতিযোগিতা সুখস্বস্তি বিঘ্নিত করে। চারপাশের অসঙ্গতি আতঙ্ক বৈষম্য অপতথ্য নিষ্ঠুরতা দেখেও নির্বিকার থাকে--নিত্যদিন এসব দেখে ‘অভ্যস্ত মানুষে’র মনে প্রতিক্রিয়া জাগে না। খুব সহজে হত্যা বা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
ত্বরিত সহজ সমাধান নেই এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার। কিছু জিনিস ঠিক হয় না, হওয়ার নয়। ওয়ানওয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে মানবজাতি। প্রতিকারও ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে সহনীয় অবস্থায় রাখার জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা, সুস্থ সস্কৃতির চর্চা, ব্যক্তির সন্তুষ্টিবোধ জাগ্রত রাখা, সমাজব্যবস্থা সুসামঞ্জস্য করা, সহায়ক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ।
আরেক সমাধান আছে: চিন্তা না করা। চোখ কান বন্ধ করে ঘরে বসে থাকা। যাচ্ছেতাই হোক, আমি বেঁচে থাকি যে কয়দিন পারি। কিছু লোক যে কোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকে, কোনোকিছুকেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মনে করে না। চোখ বুজে জীবন শেষ করে, চোখ খুললেই যে নানাধরনের ধান্ধা লাগে! সন্ন্যাসী ও পাগলের ক্ষেত্রে তা সম্ভব। আধুনিক যান্ত্রিক মানুষ ডেমকেয়ার--সমাজের দুরবস্থা বা পৃথিবীর কান্নায় তার ভোগ থামে না। আপোষরফা করে বেঁচে থাকার জন্য কেউ আবার বিরুদ্ধ পরিস্থিতিও মানিয়ে নেয়। আর আছে ধর্মান্ধতা--সৃষ্টি করেছেন যিনি, রক্ষা বা বিনাশও করবেন তিনি, এই আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকা।
উপকারিতাও নাকি আছে এই অবিশ্বাস্যরকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে। যেমন, পৃথিবীর ক্রমোন্নতির মূলে আছে মানুষকে চাপের মধ্যে রাখা। সকল আবিষ্কারের কারণ হল জোর প্রয়োজন। কর্মতৎপরতার বাহক হল জরুরী চাহিদা মেটানো, নূতনত্ব আসে বিরূপ বিস্বাদ পরিস্থিতি থেকে।
এহেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দীর্ঘ মেয়াদে কিছুই টেকসই নয়--ঘরনি নয়, ধরণীও নয়। অমৃতের সন্তান মানুষ আজ বিষাক্ত। সুখ শান্তি তৃপ্তির লক্ষণ নেই কারো মুখে, কথায় বা আচরণে। এরকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কে দায়ী, দোষ কার কতটুকু সেটা খুঁচিয়ে লাভ নেই, সবাই কমবেশি দায়ী। মূলকথা, দম বন্ধ হয়ে আসছে--পৃথিবীর এবং তার প্রাণিকুলের। সুতরাং শ্রেষ্ঠপ্রাণি মানুষকেই বিদ্যমান পরিস্থিতি সুবহ করতে হবে।
উন্নয়ন তাহলে হয়নি পৃথিবীর? দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে: যাতায়াত যোগাযোগ ক্রীড়াঙ্গন শিক্ষায়তন চিকিৎসালয় বিনোদন। দরকারি অদৃশ্য উন্নয়নগুলি মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে--দয়া মায়া স্নেহ ভালবাসা মানবতা দায়িত্ব কর্তব্য সততা সহমর্মিতা। ছড়িয়ে পড়ছে মাদক মোবাইল মেদ। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে দরকার সামাজিক সহায়তা, প্রত্যাশিত সুস্থ আয়ু, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা ও আইনের শাসন।
ফিনল্যান্ডবাসীরা সুখী কেন? তারা নিষ্পৃহ সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ, ঘরের বাইরে বা দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে বোদার করে না। চারদিকের পরিস্থিতি শান্ত বলে কোনোকিছুতেই উত্তেজনা নেই। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা না করে অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনযাপন।
যদি বলেন আন্দোলন গতি চাঞ্চল্যই জীবন, নিষ্ক্রিয়তা স্থবিরতা মৃত্যু, সেটা মানি কিন্তু তা-ও সত্য যে অতিগতি দিয়েই মৃত্যুর বাহক আসে। নিঃসঙ্গতা ঘৃণা যুদ্ধ হ্যাকিং সবই ‘অতি’র ফল: অতিউন্নতি, অতিভোগ, অতিবুদ্ধি...। এই সব নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে: ইজরায়েল থাকবে, ট্রাম্প আসবে, জলবায়ু চরম হবে। সমস্যা হল বেঁচে থাকার উপায় ও উপকরণ কমে আসছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে, মাত্রা অতিক্রম করে রেড জোনে চলে যাচ্ছে সবকিছু।
জীবন সায়াহ্নে এসে একদম স্তব্ধ হয়ে গেছি। নিজের জীবনাবসানের জন্য নয়, পৃথিবী তথা প্রাণিজগত তথা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ানক দুশ্চিন্তা জেগেছে আমার মধ্যে। কি জানি, হয়ত আমিই ভুল। প্রাণখুলে কথা বলতেও ভয় আজকাল: কার কী উদ্দেশ্য কে জানে। যা কিছু আমাদের ভয় দেখাতে পারে এবং বিরক্ত, বিভ্রান্ত ও উৎপীড়িত করতে পারে, তার সবটাই আছে ঘাপটি মেরে। সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিভক্তি বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা। আমার ভয় লাগে--এই শহরে, এই দেশে, এই পৃথিবীতে। আপনার ভয় না লাগলে ঘুমান কিন্তু যখন ঘুম ভাঙবে, ঘর সামলানোর সময় আর পাবেন না।
বার্নি স্যান্ডার্স সম্প্রতি লিখেছেন, ‘আমরা এখন এক জটিল বিশাল সংকটের মুখে পড়েছি, যা মোকাবিলা করতে না পারলে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে। বিশ্বে সব মিলিয়ে এখন যা অবস্থা, তাকে একেবারে গন্ডগোলের পরিস্থিতি বলা যায়।’ জাতিসংঘ মহাসচিবও পৃথিবীর বর্তমান অবস্থাকে ‘বিশৃঙ্খল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্য বিল গেটস দায়ী করেছেন জলবায়ু বিপর্যয়, সাইবার আক্রমণ, যুদ্ধ ও মহামারিকেÑযাদের কোনো সহজ সমাধান নেই। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে শান্তি সম্প্রীতি সমৃদ্ধির পৃথিবীতে বসবাসের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। সেজন্যই ভয় আমার।
আচ্ছা, পৃথিবী যদি গোলমেলে হয়, প্রশান্তির জন্য কোথায় যাব? অন্তর্জগতে। অন্তরকে বলি ঢেউ থামাও, উত্তাপ কমাও, হিংসা সরাও: নিজে ঠিক তো জগৎ ঠিক। পরজগৎ? ও জগৎ কীরকম, ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো। কী দিয়ে যে তাকে একটা মেসেজ পাঠাই!
সাবেক রাষ্ট্রদূত, রোম ইতালি
মন্তব্য করুন