এবারের বিজয় দিবস নানা কারণেই অন্যরকম একটা চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে বা আমরা দিবসটি পালন করেছি। এবছর বিজয় দিবস পালন করা নিয়ে জাতির মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করেছি আমরা, যা নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত। অথচ আমরা বারবার জাতীয় কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণের মীমাংসা ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলছি। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহিদ ইত্যাদি নিয়ে যদি আমাদের ব্যাখ্যা ও উদ্যাপনের মধ্যে এতো বিভক্তি থাকে, তাহলে তা দেশের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে ধরে নিতে হবে।
মাংস ভাগ করার মতো করে এবছর আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর স্বাধীন পরিবেশে বিজয় দিবস পালন করতে পেরে খুশি হয়েছে একদল। আরেকদল মনে করছে জোর করে বিজয় দিবসকে অন্য চেহারা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আরেক গ্রুপ বিজয় দিবসকে জুলাই বিপ্লব দিয়ে রিপ্লেস করতে চাইছে। এমনকি বিজয় উৎসব না লিখে ডিসেম্বর উৎসব নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আরেক দল মনে করছেন ১৯৭১ এ বিজয় আসেনি, প্রকৃত বিজয় এসেছে ২০২৪ এ। আবার অনেকে এই ধারণার বিরুদ্ধে। তারা মনে করছেন ২০২৪ আর ১৯৭১ কে মেলানো সমীচীন নয়, প্রতিটির গুরুত্ব ভিন্ন। এবছরই আমরা প্রথমবারের মতো ৭ মার্চ এর ভাষণকে অগ্রাহ্য করে বিজয়ের মাসকে উদ্যাপন করেছি। অবশ্য স্বাধীনতা বিরোধীরাও এবছর বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বিজয় দিবস ও শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে।
রাষ্ট্র সংস্কার করার করার বড় লক্ষ্য নিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তারা যদি এই দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে এক পতাকা তলে নিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ২০২৪ এর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শ বাংলাদেশ গড়া কি সম্ভব হবে? ৫৪ বছর পরে এসে জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবী শহিদদের সংখ্যা, কারা শহিদদের হত্যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করা, জহির রায়হানের অন্তর্ধান, কারা জুলাই আন্দোলন করেছে, কারা করেনি, কে শাহবাগী, কারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক-কারা নয় ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কে সময় খরচ করছি। অথচ এগুলো করার চাইতে একটি ভালো নির্বাচন কত তাড়াতাড়ি দেয়া যায়, এটাই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমরা যত বেশি বিতর্কে জড়াবো, নিজেরা ততো বেশি ভেঙে খান খান হবো। আর দেশের ভিতরে মতদ্বৈধতা যত বাড়বে, সুযোগ সন্ধানী চক্র ততো বেশি শক্তিশালী হবে। এবছর বিজয় দিবসের মতো দিনটিকে ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আয়োজন কম ছিল না, কিন্তু ঐক্য ছিল না। এই ঐক্যের অভাব এতোটাই প্রকট হয়েছে যে জাতীয় পতাকা বিক্রির উপরেও তা প্রভাব ফেলেছে। এবার ঢাকায় জাতীয় পতাকা বিক্রি কমেছে বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দেখলাম। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে যে ফেরিওয়ালারা, তারা হিজবুত তাহরিরের পতাকাও বহন করছিল বিক্রির জন্য। কাজেই জাতীয় ঐক্য কীভাবে, কেমন করে হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমরা কোনো আনন্দ বা জাতীয় উৎসব একইভাবে আয়োজন বা উদ্যাপন করতে পারছি না। অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে বিজয় দিবসের আনন্দকেও আমরা নানাভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে ম্লান করে ফেলেছি।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নায়করা মনে করেন তারা দেশ, জাতি, রাজনৈতিক দল, বঙ্গবন্ধু, জনগণের ভোটাধিকার ইত্যাদি নিয়ে যা বুঝেন, যতোটা বুঝেন এটাই সঠিক। পুরো জাতিকেও এখন তাদের মতোই ভাবতে হবে। কারো ধারণা বা মতামত তাদের ধারণার সাথে না মিললেই ’হাসিনা সরকারের দোসর’ ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। এটা কি ঠিক? একটি স্বাধীন দেশে নানাজনের নানা মত থাকবেই।
বিগত সরকারের বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় অভিযোগ ছিল তারা অন্য পথ ও মতকে অস্বীকার করেছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রিয় দাবি করলেও জনগণ তাদের কতটা অপছন্দ করে, সে ব্যাপারে তারা কোনো ধারণাই রাখতেন না। ভাবতেন তারা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সেই ভীত যে দুর্বল হয়ে গেছে সেটা ভাবেনি। একবারও ভাবেনি কোন দল বা মত ইতিহাসের অপরিহার্য শক্তি নয়। অথচ এটা যত তাড়াতাড়ি ভাবা যাবে, ততোই মঙ্গল।
বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্ব মনে করতে পারেন যে আওয়ামী লীগের নানাধরনের নেতিবাচক কাজের কারণে মানুষ তাদের পেছন থেকে সরে গেছে, বর্তমানে ছাত্ররাই ইতিহাসের অপরিহার্য চরিত্র। কিন্তু তাদের উচিত জনগণের মতামত জানা। জুলাই-আগস্টের সংগ্রামে অনেকেই তাদের সঙ্গে ছিল সত্য। কিন্তু উদ্ধত মন্তব্য, ভুল কাজ, প্রতিশোধ স্পৃহা বা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে জনগণ তাদের পেছন থেকে সরেও আসতে পারে। তরুণ নেতৃত্বের এমনকিছু করা উচিত হবে না, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে।
সেদিন একজনের লেখায় পড়লাম, পোল্যান্ডের লেখক স্তানিসোয়াভ লেমের অসাধারণ কাহিনীর একটি অংশ, যা বাস্তব অবস্থার সাথে মিলে যায়। লেখক লিখেছেন, অতি বুদ্ধিমান একটি এলিয়েন প্রাণীকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না। বহু বছর গবেষণা করেও কোন কূলকিনারা করতে পারলেন না তারা। এরপর বিজ্ঞানীরা মারাত্মক এক্স-রে বিম দিয়ে এলিয়েনটিকে আঘাত করতে শুরু করলেন। এলিয়েন প্রাণীটি এই নৃশংসতার প্রতিশোধ নিল।
প্রতিটি বিজ্ঞানীর অবচেতন মনে যে অবদমিত বিকারগ্রস্ত, ক্রুর, খারাপ চিন্তা ছিল, সেগুলোকে বাস্তবে রুপান্তরিত করে এলিয়েনটা বিজ্ঞানীদের কাছেই পাঠিয়ে দিতে লাগল। লেখক বুঝাতে চেয়েছেন মানুষ মনে করে যাকে বুঝতে পারছো না তাকে যন্ত্রণা দাও, তাকে হত্যা কর, তার সবকিছু বিনাশ কর। তাহলেই হয়ত সে অনুগত হবে। কিন্তু তা হয় না। বরং উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। কাজেই যে যতোই ক্ষমতাধর হোক না কেন, অন্যের উপর জোর খাটানো যাবে না।
বিভক্ত সমাজ ও রাজনীতি দেশকে যে এক রেখায় আনতে পারে না, এর প্রমাণ বাংলাদেশ। ৫৪ বছরেও দেশের মূল পরিচয় নিয়ে রয়ে গেছে বিভক্তি এবং এই বিভক্তি ক্রমে বাড়ছে। আমরা কল্পনার বাংলাদেশ এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি না। দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই যুদ্ধ এবং তার আগে-পরের আন্দোলনে যে-সব ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সময়, শ্রম ও জীবন দিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে যে-সব নেগেটিভ কাহিনি প্রচলিত আছে, আমরা এখন শুধু সেটাই গ্রহণ করছি। বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ প্রবণতা থেকে আমাদের মধ্যে বাড়ছে বিদ্বেষ, সন্দেহ এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ইত্যাদি।
ইউটিউবে যেসব আজেবাজে ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বিরোধী মতের মানুষকে পচাঁনো বা ট্রল করা যাই থাকুক না কেন, এই কাজগুলো যারা করেন, তারা মানসিক ও ব্যক্তিত্বের সমস্যায় ভুগছেন। তারা নানা মাত্রায় হ্যালুসিনেশন, বিভ্রান্তি বা অসংগঠিত চিন্তাভাবনা নিয়ে বসবাস করছেন। কথা বলার স্বাধীনতা আছে, এই যুক্তিতে তারা নিজেরা যেভাবে ভাবছেন, সেইভাবেই বলছেন, সেভাবেই অন্যদের দেখানোর চেষ্টা করছেন। নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা এক ধরনের অপরাধ। এতে কারো কোনো লাভ হয় না, বরং সমাজে দ্বন্দ্ব বাড়ে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হয়। সম্পর্ক গড়তে অনেক সময় লাগে কিন্তু সম্পর্ক ভাঙতে তেমন কিছুই লাগে না। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি, মতের অমিলই যথেষ্ট।
মানুষ যখন তাদের কৃতিত্বকে অতিরঞ্জিত করে, তখন বুঝতে হবে সে বা তারা নার্সিসিস্ট। নার্সিসিস্ট মানুষের সাথে সম্পর্ক দানা বাঁধে না। এরা নিজেদের কৃতিত্ব নিয়ে এতোটাই অন্ধ থাকেন যে দেশ ও জাতি নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচার, কল্পনার ফানুস ওড়ানো, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করতে দ্বিধা করেন না। এতে দেশের কতটা মঙ্গল হবে জানি না কিন্তু সামাজিক বন্ধন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এখন যে যার মতো কাজ করছেন, কথা বলছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাই চারিদিকে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমরা আশা করছি নিঃশব্দ এই উৎকণ্ঠার সময় দ্রুত শেষ হোক, দেশে নির্বাচিত সরকার আসুক।
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
মন্তব্য করুন