বিশ্ব মানচিত্রে চীন প্রবলভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি এখন চীন। এটা নিয়ে দ্বিমত করার ও কোন উপায় নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির বিপরীতে চীন হাতে নিয়েছে নানা ভূরাজনৈতিক কৌশল। তার অন্যতম একটি কৌশল হলো বি. আর. আই প্রকল্প। এই বি.আর.আই বা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পকে বলা হয় গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি বা শতাব্দীর বড় মহাপরিকল্পনা। কোন কোন দেশ আবার মনে করে চীনের এই মহাপরিকল্পনা আসলে একটি ঋণের ফাঁদ। যা বহু দেশকে কার্যত অকার্যকর করবে। দুর্বল ও পরজীবী রাষ্ট্রে রুপান্তরিত করবে।
চীন তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে বিভিন্ন দেশকে কাছে টানতে চায়। দিতে চাই আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও। তার বিনিময়ে পেতে চায় বন্দর কিংবা করিডোর সুবিধা। চীনের এই প্রকল্পের অন্যতম বিরোধী দেশ হলো ভারত।ভারত মনে করে এ অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা ব্যঘাতে এ ধরনের প্রকল্প সরাসরি সার্বভৌমত্বে আঘাত হানবে। ভারত দাবি করে চীন মূলত ঋণ কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এ অঞ্চলে আধিপত্য কায়েম করতে চায়। আঞ্চলিক সহযোগিতার নামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে ছোট ছোট দেশগুলোকে নিজের কব্জায় নিতে চায়।
উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নামে প্রথমে অর্থ ধার দেয়। পরে সেই ঋণ শোধ করতে না পারলে পুরো প্রকল্পটাই তাদের নিজের হাতে তুলে নেয় কিংবা সেই দেশে আরও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে । তাইতো ভারত বরাবরই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে শুরু থেকে। এখন এই ভারতকেই টেক্কা দিতে চীনের সাথে হাত মিলিয়েছে নেপাল। দীর্ঘ বোঝাপড়ার পর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে মোট ১০টি চুক্তি ও চূড়ান্ত করেছে হিমালয়ের কন্যা খ্যাত এই দেশটি। নেপালের এই যোগদানে কেন স্পষ্টই চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে নয়াদিল্লির কপালে?
এটি বুঝতে গেলে যে খুব গভীরে প্রবেশ করতে হবে এমনটা কিন্তু নয়। নয়াদিল্লির আপত্তি অগ্রাহ্য করে পোখরা বিমান বন্দরের কাজে চীন থেকে ২০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা নিয়েছিল নেপাল। গত বছর এই পোখরা বিমানবন্দর খোলা হয়েছে। ভারত সীমান্তের খুবই কাছে এই বিমানবন্দরটি অবস্থিত। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, সামরিক বিমান ঘাঁটি হিসেবে পোখরা বিমান বন্দরকে ব্যবহার করতে পারে বেইজিং। যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা জন্য বড় হুমকি। এছাড়াও বাণিজ্যিক চুক্তির নামে নেপাল ও চীনের যোগাযোগ সম্প্রসারণ চুক্তি যা স্পষ্ট ভারতের জন্য সার্বভৌমত্বের হস্তক্ষেপ ভাবছে নয়াদিল্লি।
বাংলাদেশ ও নেপালের আয়তন প্রায় সমান সমান।আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪ তম এবং নেপালের অবস্থান ৯৩ তম। আবার জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ নেপালের প্রায় চার গুণ। নেপাল একটি ল্যান্ড লক বা স্থল বেষ্টনী দেশ। এদেশের কোন সমুদ্র বন্দর নেই। তাইতো নেপাল তাদের দুই প্রতিবেশী তথা পৃথিবীর অন্যতম দুই বৃহৎ পরাশক্তি ভারত ও চীনের উপর নির্ভর করতো প্রবহমান কাল থেকে। পূর্বে ভারত ও চীনের দোদুল্যমান সম্পর্কের উপর নির্ভর করতো নেপালের ভাগ্য। অনেকটা দাবার গুটির মত ব্যবহৃত হতো তারা। নেপাল ও চীন তাদের নিজেদের মধ্যে সীমানা শেয়ার করে ১৭৫১ কিলোমিটার অন্যদিকে নেপাল ভারতের সাথে শেয়ার করে ১৩৮৯ কিলোমিটার।ভৌগোলিকভাবে নেপাল একটি পর্যটন নির্ভর দেশ।
ভূ-প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের দেশের শিল্প কারখানার তেমন ভাবে গড়ে উঠেনি। নির্ভর করতে হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতার উপর। শত প্রতিবন্ধকতার পরও আজকের দিনে নেপালের জিডিপি ও আস্তে আস্তে বাড়ছে। ভূ-রাজনৈতিক ভাবে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ও এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এই মুহূর্তে চীনের সাথে নেপালের জোট নিঃসন্দেহে একটি ভিন্ন বার্তা দেয় বিশ্ব মহলে। ভারত যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তি সে অজুহাতে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে প্রতিনিয়ত চাপে রাখতে চায় চীন। যদি এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য কোনভাবে ঠেকানো যায় তাহলে বাণিজ্য পথের পুরো সুফল পাবে চীন। যা তাদের বি. আর. আই এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সুনিশ্চিত করতে টনিক এর মতো কাজ করবে।
নেপালে এই বছর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় বসেছে কেপি শর্মা ওলি। পদে বসার পর, বিদেশ সফর হিসাবে মি. ওলি প্রথম চীন সফর করেছেন। যা সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন এক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। নেপালে একটি অঘোষিত নিয়ম চালু আছে যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মসনদে বসেন তিনিই প্রথম দিল্লিতেই আসেন। আশ্চর্যপূর্ণ ভাবে এবার সবাইকে তাক লাগিয়েছেন মি. ওলি। অনেকটা প্রথা ভেঙে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর, প্রথম কোন বিদেশ সফর হিসেবে ভারতের বদলে চীনকে বেছে নিয়েছেন তিনি।
এই সফরেই চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মি. ওলি বেল্ট অ্যান্ড রোডে যোগদান নিয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। যদিও ২০১৭ সালে প্রাথমিকভাবে এই দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। তার পর চুক্তি সম্পূর্ণ হওয়া নিয়ে সাত বছর নানা আলোচনা হয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। অবশেষে এই চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে এই মাসে। এখন থেকে বি.আর.আই প্রকল্পের অন্যতম অংশীজন নেপাল ও। ফলে সব মিলিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে, আড়ালে কি তাহলে বেজিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পররাষ্ট্রনীতি বা কূটনীতির বদল করছে নেপাল?
এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়াতে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান মজবুত করছে চীন। ছোট ছোট দেশগুলোকে টার্গেট করছে তারা। চীন ভালো করে জানে দক্ষিণ এশিয়াতে চীনের আধিপত্য বজায় রাখতে এই ছোট ছোট দেশগুলোই একমাত্র ভরসা। দক্ষিণ এশিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের ও এক ধরনের খবরদারির দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। চীন ভালো ভাবে জানে এসব খবরদারি তাদের মুক্ত বাজার ব্যবস্থা ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে চরম বাধা। তাই কৌশলে তারা ছোট ছোট দেশগুলোকে ঋণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শুল্ক হার কমানো, বাণিজ্য সুবিধা সহ নানাবিধ সুবিধা প্রদান করে সুকৌশলে। তাইতো নেপালের মতো অন্য দেশও ভিতরে ভিতরে চীনের মতন বড় লগ্নিকারী দেশ থেকে এসব বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে পিছু পা হটে না।
চীনের কাছে বরাবরই পছন্দের দেশ বাংলাদেশ। তাইতো বাংলাদেশকে চীন পাশে পেতে চায়। আমরা ও চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে উদগ্রীব। কারণ আমাদের দেশে রয়েছে চীনের বড় বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে নানা ফিরিস্তি। আমরা ও ভালো করে জানি চীন এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম গ্রেট পাওয়ার। ভারতের সাথে আমাদের এই মুহূর্তে তিক্ত সম্পর্ক চলছে। সম্পর্কের পারদ দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। ভবিষ্যতে যে ভালো হবে তারও কিন্তু কোন লক্ষণ নেই।
আবার এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারে অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ চীন ও ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চায় এই দেশ দুটোকে সর্বদা ব্যস্ত রাখতে। যাতে করে তাদের নিরাপদ বাণিজ্য সম্প্রসারণ সুনিশ্চিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না এসব দেশ কিন্তু নিজেদের স্বার্থে অন্যদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মুখাপেক্ষী। স্রেফ এখানে কাজ করে বাণিজ্যের কৌশল ও নগদ ব্যবসা। তাই আমাদের পদক্ষেপ সুকৌশলে নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে বি. আর.আই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে ২০১৬ সালে। এই প্রকল্পে ইতিমধ্যে যুক্ত আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও পাকিস্তান। আর এখন যুক্ত হলো নেপাল। এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের মূলত অসন্তোষ পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে নিয়ে। যা নিয়ে চীনের সাথে রয়েছে তাদের তীব্র বিরোধ। চীনের এই পরিকাঠামো উন্নয়নকে বরাবরই দিল্লি বলছে প্রতারণার ফাঁদ ও সামরিক আগ্রাসনের সম্প্রসারণ। যদিও এটা মানতে না রাজ চীন। চীন মনে করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই জনপদে টেকসই উন্নয়ন তারাই শুধু দিতে পারবে। এই অঞ্চলে অবাধ, মুক্ত ও নিরাপদ বাণিজ্য পথ নির্মাণে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এশিয়াকে সুন্দর কলেবরে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে বি. আর.আই এর কোনো বিকল্প নাই।
উল্লেখ্য, বহুদিন ধরেই নেপালে বাড়ছে চীনের প্রভাব। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ড চীনপন্থি বলে পরিচিত ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে চীনে গিয়ে জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। শি জিনপিংকে নেপালের ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রচণ্ড। এখন চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব মজবুত করছেন ওলি। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে ভারত। কারণ উদ্বেগ বাড়িয়ে একে একে সব পড়শি দেশেই প্রভাব বিস্তার করছে চীন। স্পষ্টই ভারত এই জনপদ এখন অসহায় খেলোয়াড়। তার বন্ধুর খাতা দিন দিন কমছে। বড্ড একা হয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিপদে সাহায্য করার মতো আর কোনো প্রতিবেশী দেশ অবশিষ্ট রইল না।
এতদিন ধরে যারা ভারতকে অনেক সহযোগিতা করতো তারাই এখন কার্যত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু উগ্র জাতীয়তাবাদ, মিথ্যাচার, প্রচারণা, দুর্বল নীতি ও ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতির কারণে দিন দিন তারা ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চীনের একটি বড় বাজেটের আন্তর্জাতিক প্রকল্প। যার মাধ্যমে নতুন নতুন সড়ক, রেল ও বিমানপথ তৈরি করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়া সম্ভব। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১৫১টি দেশ এই প্রকল্পের আওতায় আছেন। এটি একটি মেগা ও মহা পরিকল্পনা বটে। বিআরআই-এর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, চীন প্রকল্প বিস্তারের নামে বহু দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা খর্ব করেছে। তারপর ও এতো সমালোচনার পরে যদি চীনের এই মহা পরিকল্পনা সফল করা যায়, তাহলে বৈশ্বিক আমদানি ও রপ্তানি পথ অনেকটা সহজ হবে। বিশ্বায়নের যুগে নতুন অর্থনৈতিক সুফল ভোগ করবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
মন্তব্য করুন