ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করতে ডেথ রিভিউ কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেথ রিভিউ, ন্যাশনাল র্যাপিড রেসপন্স টিম (NRRT) কর্তৃক বিভিন্ন রোগের তদন্ত কাজের একটি অংশ। প্রয়োজন বিশেষে, বিভিন্ন বিষয়ে স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে রোগ প্রাদুর্ভাবের কারণ নির্ণয় এবং মৃত্যু পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে ‘ডেথ রিভিউ কমিটি’ গঠন করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বয়সী রোগীর অথবা বিভিন্ন রোগের জন্য ডেথ রিভিউ কমিটি আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ভারত ও মালয়েশিয়াতেও ‘ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি’ আছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া প্রাদুর্ভাব ও ২০১৮-২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির তদন্ত পরিচালনার জন্য ডেথ রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল ১৭০৫ জন। ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯৭ হাজারের বেশি এবং মারা গিয়েছে ৩৫১ জনেরও অধিক। যদিও এক সংখ্যাটি সম্পূর্ণ নয় কারণ এ সংখ্যাটি শুধুমাত্র যেসব হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে রিপোর্ট করে তাদের সংখ্যা।
এই রোগী ছাড়াও প্রচুর রোগী ছোট বড় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। আবার কিছু রোগী আছে যারা জ্বর আসলে পরীক্ষা না করিয়ে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে অথবা কবিরাজের কাছে যাচ্ছে। এই রোগীদের মধ্যেই প্রকৃত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।
পৃথিবীতে উষ্ণ আর্দ্রীয় অঞ্চলের অনেক দেশেই ডেঙ্গু রোগী আছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি আছে ব্রাজিলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই যেকোনো রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার হিসাব এবং পর্যবেক্ষণ করে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার অতি উচ্চ। ২০২৩ সালে বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার (CFR) ছিল ০.৫৩ শতাংশ আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৫৫ শতাংশ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মৃত্যুহার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা খুব সফলভাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমাতে পেরেছে।
পৃথিবীতে ডেঙ্গুর অন্যতম ঝুঁকির দেশ হচ্ছে ব্রাজিল এবং ফিলিপিন। এই দেশগুলোতেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। ব্রাজিল এবং ফিলিপিনে মৃত্যুর হার যথাক্রমে ০.০৪৯ ও ০.৩৪ শতাংশ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ০.০১ শতাংশেরও কম।
যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশে সংক্রামক রোগে মৃত্যুহার তত কম। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার এত বেশি কেন এবং একে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা বা পর্যালোচনা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে ডেঙ্গুর ‘ডেথ রিভিউ’।
যেকোনো নতুন বা পুরাতন রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তদন্ত কাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের র্যাপিড রেসপন্স টিম রয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (IEDCR) এ। জাতীয় পর্যায়ের এই ন্যাশনাল র্যাপিড রেসপন্স টিম (NRRT) এর চেয়ারপার্সন থাকেন আইডিসিআর (Institute of Epidemiology Disease Control And Research IEDCR)-এর পরিচালক এবং এর অফিস আইডিসিআর-এর কার্যালয়ে।
ন্যাশনাল র্যাপিড রেসপন্স টিম (NRRT) তাদের তদন্ত কাজের অংশ হিসেবে যেকোনো এলাকার রোগের তথ্য সংগ্রহ করে তার কারণ এবং রোগ পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের জটিলতা এবং রোগ প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে পর্যালোচনা করে। আমার জানামতে, বর্তমানেও ‘ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি’ আইইডিসিআর-এর ন্যাশনাল র্যাপিড রেসপন্স টিম (NRRT) এর চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের তদন্ত কাজের অংশ হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটি সাধারণত দেশের স্বনামধন্য মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক্স, ইপিডেমিওলজি ও ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। তবে প্রয়োজনে অনন্য বিষয়ের সম্মানিত বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
‘ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি’-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো যেকোনো সন্দেহজনক ডেঙ্গুজনিত রোগের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণের পাশাপাশি এর জটিলতা বিশ্লেষণ, রোগীকে প্রদান করা চিকিৎসা এবং রোগের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা। সেইসব তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিতকরণের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা প্রদান করা।
দেশের যেকোনো হাসপাতালে অথবা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সন্দেহজনক ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া মাত্র আইইডিসিআর সেসব রোগীর হাসপাতাল রেকর্ড, ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ফলাফল এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর পূর্বে সংগৃহীত নমুনা সংগ্রহ করে।
একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর প্রতিটি মৃত রোগীর নিকটাত্মীয় যারা রোগীর মৃত্যু পূর্ববর্তী উপসর্গ বা চিকিৎসাসমূহ সম্বন্ধে জানেন তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত ফরমে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় যা ভারবাল অটোপসি (Verbal Autopsy) নামেও পরিচিত।
যেসব ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ সম্ভব হয় আইইডিসিআর সেসব নমুনার পরীক্ষা সম্পন্ন করে। ‘ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি’ ভারবাল অটোপসি রিপোর্ট, হাসপাতাল রেকর্ড, ল্যাবরেটরি তথ্য প্রমাণ পর্যালোচনা করে উল্লিখিত রোগীর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে পরামর্শ প্রদান করে, যা জাতীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
‘ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি’ প্রতিটি সন্দেহজনক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে—
১) রোগীর মৃত্যুর পূর্বে হাসপাতাল অথবা ল্যাবরেটরি কর্তৃক সংগৃহীত নমুনার কনফার্মেটরি পরীক্ষা করা (PCR for Dengue);
২) রোগীর মৃত্যুর পূর্বে হাসপাতাল অথবা ল্যাবরেটরি কর্তৃক ডেঙ্গু ও অন্যান্য পরীক্ষার রিপোর্ট বিশ্লেষণ;
৩) রোগের উপসর্গ, রোগের গতি প্রকৃতি, জটিলতা, চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি বিশ্লেষণ;
৪) রোগীর শারীরিক অবস্থা, ডেঙ্গু ছাড়া অন্যান্য রোগের ইতিহাস বিশ্লেষণ;
উপরোক্ত পদ্ধতির ভিত্তিতে রোগী ভেদে বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে রোগীর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত ফরমেট অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সিস্টেমেটিক একটি ডেথ রিভিউ কমিটি থাকার পরেও ডেঙ্গু মৃত্যুহার কেন কমানো যাচ্ছে না এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটি রিপোর্ট কি ফাইলবন্দি থেকে যায় নাকি এটি চিকিৎসা ব্যবস্থায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে সেটি জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেক দেশের যেকোনো সংক্রামক রোগের ডেথ রিভিউ কমিটি রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল যা রোগ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপাদান। প্রতিটি ডেথ রিভিউ কমিটি রিপোর্ট সব চিকিৎসক এবং গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই রিপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হলে বাংলাদেশের ডেঙ্গু মৃত্যুহার কমানোর কার্যকরী উপায় বেরিয়ে আসতে পারে।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
মন্তব্য করুন