বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

দিল্লি তুমি রিয়েলিটি মেনে নাও

মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৪২

রিয়েলিটির ঝড় মেনে ধাওয়া খেয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় জুটেছে সিরিয়ার প্রতাপশালী বাশার আল আসাদের। শেখ হাসিনার আশ্রয় হয়েছে ভারতে। ১৯৮১-তে যেখান থেকে বাংলাদেশে তার আগমন ২০২৪-এ সেখানেই তার নির্গমন। এটাই বাস্তবতা, রিয়েলিজম। একাত্তরে পাকিস্তানিরা রিয়েলিটি ‘মাইনে’ নেয়নি। পরিণাম ভুগেছে। গত কয়েক বছর ধরে রিয়েলিটি মানছে না বাংলাদেশের প্রতিবেশি ভারত। চারদিকের প্রতিবেশিদের জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলছে। শেষতক কুলাতে পারছে না। আবার হালও ছাড়ছে না, দমছে না। উগ্রবাদের গোঁয়ার্তুমিতে ঠেলছে-ধাক্কাচ্ছে।

একনায়কত্বের দর্প এভাবেই গুঁড়িয়ে যায়। তা নির্দিষ্ট কোনো দেশে নয়। সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ সবখানেই। জাগতিক এই রীতি অতি প্রাচীন। শাসক হীরক রাজা হয়ে উঠলে ভবিষ্যতেও তা হবে। কেবল সময়ের ফের মাত্র। নতুন এক বাংলাদেশ মানতেই পারছে না ভারত। গণআন্দোলনের তোড়ে গদিচ্যুত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ভারত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা না করছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দ্রুত বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন, নইলে নতুন বাংলাদেশ দেখতে মিস করবেন তিনি। কিন্তু, উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভু মোদি নতুন বাংলাদেশকে আমলে নিয়েও নিচ্ছেন না। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আগের বাংলাদেশ আর নেই। রিসেট বাটনে এটি শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশ।

মোদির ভারতের জন্য এটি চরম কষ্টের। প্রতিবেশিদের ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত এখন নিজেই কোনঠাসা। বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার মোহগ্রস্ত দেশটি দক্ষিণ এশিয়াতেই দুষ্টরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানও এড়িয়ে চলছে ভারতকে। সবগুলো দেশেই ভারতীয় মর্জির বিপরীত সরকার। পাকিস্তান, চীন এবং শেষতক বাংলাদেশও ছেড়ে কথা বলছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশকে পিষিয়ে মারতে মারতে এখন গোটা বিশ্বময় ভারতের স্বরূপ উদাম হয়ে গেছে।

এক সময় বলা হতো বাংলাদেশের দম ফেলার সুযোগ নেই। কারণ এর তিনদিকেই ভারত। আর এখন ভারতের চারদিকেই তার প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের নাটক ও অভিযোগ সাজাতে গিয়ে একদিকে ভারতের চরিত্রের কদাকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। আরেকদিকে হিন্দুদের হাতে ধরে অনিরাপদ করে ছাড়ছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর ভারতের অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ থেমে নেই।

ভারতের নিজের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে না পেরে ভারত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। সর্বহারার মতো এখন ভারতের ঠুনকো অস্ত্র সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে ঘায়েল করা। হাল না ছেড়ে খেলছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস-ইসকনকে নিয়ে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক প্রতিবাদ নয়। তারওপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।

দেশের ভেতরে বাইরের ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে হলে জাতীয় ঐক্য গড়ার একটি সূত্রপাতও এরইমধ্যে হয়েছে। বুধবার ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স ও আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস সার্টিফিকেট প্রদান শেষে বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।

এরপর সংলাপে বসেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। তার এ জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়ার আলাদা রয়েছে। আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন এখন সামরিক এবং বেসামরিক শক্তির শক্ত সেতুবন্ধন তৈরির তাগিদ আসছিল বিভিন্ন মহল থেকেই। এখন এর কার্যকর বাস্তবায়নের অপেক্ষা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নেতা এবং জাতীয় ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ একঠি ভালো নমুনা। সেইক্ষেত্রে ভারত প্রশ্নে একটি অবস্থানে পৌঁছবে বাংলাদেশ।

অবিরাম তিক্ততায় সম্পর্ক মেরামতের জায়গাও নষ্ট করে দিয়েছে ভারতই। দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বদলে তারা সম্পর্ক গড়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, শেখ হাসিনার সঙ্গে। এ থেকে তারা সরবে বলে আলামত নেই। যে কারণে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সামনের দিনগুলাতে আরও তিক্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা ভর করেছে। আগরতলায় বাংলাদেশের হাই কমিশনে হামলা, লুট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের বাকযুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে।

চিকিৎসা সেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে দুই দেশে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করার ঘটনাসহ সাম্প্রতিক অস্থিরতা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত ১৫-১৬ বছর ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নানা স্বার্থ রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগিয়ে তারা কেউই ভারতের সাথে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত নয়।

ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতা আগেও ছিল, এখন তা বরং বেড়েছে। তারওপর বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখছে দুই দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো। গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো তুলনামূলক ভালো করেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন করা হচ্ছে, এমন প্রচার চালিয়ে ভারতের জনগণকে আরও বেশি মুসলিমবিদ্বেষী করার এজেন্ডায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। তারা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চায়।

একইভাবে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন সম্পর্কে ভুয়া ও অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে। যা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা আরও বাড়াচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় দিল্লি দেখতে চায় না। সেই সমীকরণে ভারতের খাস পছন্দ আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছেন, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন, তারা তা আজীবন মনে রাখবে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো আগেই পরিষ্কার। সেখানে গণআন্দোলনে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। ভারত ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশ আশ্রয় দেয়নি তাকে। এটি ভারতের জন্য কতো লজ্জা, কষ্টের তা ভারতই জানে। শেখ হাসিনাকে কেবল সুরক্ষা নয়, আবার ক্ষমতাসীন করার কাজও করছে ভারত। তাও আবার চরম নোংরাভাবে।

যে বিপ্লব তাদের খাস পছন্দের নেতা হাসিনার পতন ঘটিয়েছে, তাকে খাটো করে দেখাতে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে একটি আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারতের বিজেপি সরকার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মী–সমর্থকেরা সব ধরনের রাখঢাকের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। ভারতের বিজেপি সরকার তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দেশটির বিজেপিবিরোধী নেতারাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির নিরিখেই বাংলাদেশকে দেখেন।

রিয়েলিটিকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করে ভারত কোন সন্ধিক্ষণ বরণ করবে সময়ই বলে দেবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য নিয়ে ভারত এমনিতেই ঝামেলায় আছে। মণিপুরে নাজুক পরিস্থিতি। সম্প্রতি মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল দুহোমা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। লাল দুহোমা এ আহ্বান এক মাস আগে দিলেও এতদিন তা গোপন রাখা হয়েছিল। এসব পরিস্থিতি ভারতের জন্য শুভলক্ষণ নয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

মন্তব্য করুন