বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় অনুপাতে

মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:২৯

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আর অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় অনুপাতে হয়ে থাকে। কিন্তু (অন্যায়কারীকে) শোধরানোর উদ্দেশ্যে যে ক্ষমা করে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা আশ শূরা, আয়াত: ৪০)। ইসলামে শাস্তির বিধান অবশ্যই রয়েছে কিন্তু পাশাপাশি ক্ষমা এবং মার্জনার নির্দেশও রয়েছে।

ইসলামে পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর মত বাড়াবাড়ি নেই। এর সুমহান দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়। তিনি (সা.) যখন দেখেন, অপরাধীর সংশোধন হয়ে গেছে তখন চরম শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। মহানবির (সা.) ওপর, তার (সা.) সন্তান-সন্ততির ওপর এবং তার (সা.) সাহাবিদের ওপর হেন কোনো অন্যায় বা অত্যাচার নেই যা করা হয় নি কিন্তু শত্রু যখন ক্ষমার প্রত্যাশী হয়ে ক্ষমা কামনা করেছে তখন বিশ্বনবি, মানবতার নবি ও সম্প্রীতির নবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মক্কা থেকে হিজরতের সময় মহানবির (সা.) আদরের কন্যা হজরত যয়নবের ওপর এক পাষণ্ড হাব্বার বিন আসাদ বর্শা দিয়ে প্রাণঘাতি আক্রমণ করে। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সেই হামলার কারণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তার গর্ভপাত ঘটে। অবশেষে এই আঘাত তার জন্য প্রাণহারী কারণে পরিণত হয়। এ অপরাধে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার রায় প্রদান করা হয়।

মক্কা বিজয়ের সময় এই ব্যক্তি কোথাও পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে মহানবি (সা.) যখন মদিনায় ফিরে আসেন তখন হাব্বার মদিনায় মহানবির (সা.) সকাশে উপস্থিত হয়ে বলে, আপনার ভয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বড় বড় অপরাধ রয়েছে আর আপনি আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু আপনার দয়া এবং মার্জনার খবর আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। যদিও আপনি আমার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দিয়েছেন কিন্তু আপনার ক্ষমা এবং মার্জনা এত ব্যাপক যে, এরফলে আমার মাঝে এই সাহস সৃষ্টি হয়েছে আর আমি আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। আরও বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর নবী! আমরা অজ্ঞতা এবং শিরকে নিমজ্জিত ছিলাম, আল্লাহতায়ালা আমাদের জাতিকে আপনার মাধ্যমে হিদায়াত দিয়েছেন এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন।

আমি আমার সীমালঙ্ঘন এবং অপরাধ স্বীকার করছি, আপনি আমার অজ্ঞতা উপেক্ষা করুন। এতে মহানবি (সা.) তাকেও ক্ষমা করেন এবং বলেন, যাও হাব্বার! তোমার ওপর আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ হয়েছে, তিনি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের এবং সত্যিকার তওবা বা অনুশোচনা করার তৌফিক দিয়েছেন’ (আল মাজুমুল কাবির লিল তিবরানী, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৩১, মুসনাদ আন নিসায়ে যিকরে সুনানে জয়নাব, হাদিস: ১০৫১, আল সিরাতুল হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩১-১৩২, বৈরুত-২০০২)।

অনুরূপভাবে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত আছে, একজন কবি যার নাম ছিল কা’ব বিন জহির। সে মুসলমান নারীদের সম্পর্কে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় কবিতা লিখতো, তাদের সম্ভ্রমে হামলা করতো। তার বিরুদ্ধেও শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল। যখন মক্কা বিজয় হয় তখন কাবের ভাই তাকে পত্র লিখে, মক্কা বিজয় হয়েগেছে, তোমার জন্য ভালো হবে মহানবির (সা.) কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। সে মদিনায় এসে পরিচিত এক ব্যক্তির ঘরে অবস্থান করে আর মসজিদে নববীতে গিয়ে মহানবির (সা.) সাথে ফজরের নামায পড়ে।

এরপর নিজের পরিচয় না দিয়েই সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল! কাব বিন জহির অনুশোচনার সাথে ফিরে এসেছে এবং ক্ষমা চাচ্ছে, যদি অনুমতি থাকে তাহলে তাকে আপনার সকাশে উপস্থিত করা যেতে পারে। তিনি (সা.) যেহেতু তার চেহারা সম্পর্কে জানতেন না, তাকে চিনতেন না বা হতে পারে সে ব্যক্তি মুখ ঢেকে রেখেছিল যার ফলে অন্যান্য সাহাবিরাও চিনতে পারেনি, তাই তিনি (সা.) বলেন যে, হ্যাঁ, সে আসতে পারে।

তখন সেই ব্যক্তি বলে, আমিই কাব বিন জহির। তখন এক আনসারি তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কেননা, তার অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধেও মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মহানবি (সা.) পরম স্নেহ পরবশ হয়ে বলেন, একে ছেড়ে দাও, কেননা, সে ক্ষমা প্রত্যাশী হয়ে এখানে এসেছে। এরপর সে মহানবির (সা.) সন্নিধানে একটি কাসিদা বা কবিতার অর্ঘ্য পেশ করে। মহানবি (সা.) তার এক দৃষ্টিনন্দন চাদর তখন পুরস্কারস্বরূপ তাকে উপহার দেন।

এই শত্রু, যার বিরুদ্ধে মৃত্যু দণ্ডাদেশ জারী করা হয়েছিল, তার দরবার থেকে শুধু প্রাণ ভিক্ষা নিয়েই ফিরেনি বরং পুরস্কার সহকারে ফিরে গিয়েছে। এমন আরো অনেক ঘটনা মানবতার নবি ও দয়ার সাগর নবি শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে দেখা যায়।

যা থেকে স্পষ্ট হয়, সংশোধনের পর তিনি (সা.) তার ব্যক্তিগত শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন, তার নিকটাত্মীয়ের যারা শত্রু ছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছেন এবং ইসলামের শত্রুদেরও ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে সংশোধনের জন্য শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে তিনি শাস্তিও দিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা যেখানে শাস্তির কথা বলেছেন সেখানে ধনী-দরিদ্র সবার সাথে সমান ব্যবহারের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা রাব্বুল আলামিন যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ঠিক ততটাই শাস্তি দাও যতটা অপরাধ করেছে এবং শাস্তি প্রদানের কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ কর।’ মহানবি (সা.) ঠিক তাই করেছেন।

আর আমরা দেখতে পাই, মদিনায় শাসনকালে মহানবি (সা.) এবং তারপর খলীফারা পবিত্র কুরআনের নির্দেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে এর শিক্ষা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন, কীভাবে শাস্তি দেয়া উচিত আর শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যই বা কী।

আমাদের সব সময় দৃষ্টিতে রাখা উচিত, সমাজ ও দেশ থেকে নৈরাজ্য দূর করতে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর আমলের বিকল্প নেই। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা উপলব্ধি করার এবং নিজ জীবনে তা বাস্তবায়ন করার তৌফিক দিন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
[email protected]

মন্তব্য করুন