আশির দশকে রংপুর থেকে আমাদের বাসায় এলো বেলাল। ফাই-ফরমাশ খাটতো, ছোট ভাইয়ের সাথে খেলতো আর একটু-আধটু পড়াশোনা করতো। তখন সপ্তাহান্তে বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখাতো। বেলাল সেই সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক ছিল। সিনেমাতে হিরো যখন ভিলেনকে মারতো বা কোন মারামারির দৃশ্য দেখাতো, বেলাল তখন মবের পক্ষ নিয়ে দর্শক হিসেবেই সেই মারামারিতে উৎসাহ দিতো। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠতো, “পিটা, আরো পিটা ক্যানে। আউশ করি পিটা, মারি ফ্যাল ওমারলাক।”
বেলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঐটাতো সিনেমা, তাও তুই এতো উত্তেজিত কেন?” বললো, বুজান হাতের কাছে ওমাক (ভিলেন) পাছোনা তো। পালি পড়ে পিটি সিদা বানে দিতাম।” ভিলেনকে এই সিদা বানানোর ব্যাপারটাই হচ্ছে আজকের গণপিটুনিদাতাদের মানসিকতা। এখানে যাকে পিটানো হচ্ছে, ধরেই নেয়া হয় সেই ব্যক্তি অপরাধী। তাই কোনোরকম খোঁজ না নিয়েই একদঙ্গল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে হত্যা করার জন্য।
চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১০০ জন মানুষ (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র)। গণপিটুনিতে এতো মানুষের মৃত্যু যে সমাজের নেতিবাচক পরিস্থিতিকে উপস্থাপন করে, তা আর লিখে বোঝানোর দরকার নেই। তবে আমরা যারা গণপিটুনিতে মৃত্যু দেখছি, তারা এসব দেখাতে ক্রমশ বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কাউকে গণপিটুনি দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কারণ লাগে না, সুযোগ তৈরি হলেই হলো।
যারা গণপিটুনিতে অংশ নিচ্ছেন, তারা অধিকাংশ সময় ভিক্টিমকে চেনেন না এবং মারার সঠিক কারণও জানেন না, জানেন শুধু মারামারিতে অংশ নিতে হবে। এখানে সাধারণত কোন পরিকল্পনাও থাকে না। যেসব মানুষ একা কাউকে হত্যা করার বা পিটানোর সুযোগ ও সাহস পায়না, তখন সে অপেক্ষায় থাকে মনের ক্ষোভ মেটানোর একটা সুযোগ কখন আসবে। এলেই মারামারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কারণ যাই থাক।
বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। বছরে গড়ে ১০০ জন করে মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। সাধারণত ছেলেধরা, ডাকাত ও চোর সন্দেহে ওই ব্যক্তিদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। গণপিটুনির ঘটনায় বড় ধাক্কা লেগেছিল তখন, যখন ঢাকাতে সন্তানকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে নির্মমভাবে নিহত হলেন এক স্কুলশিক্ষিকা। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)
এর আগে ও পরে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন অনেকে। তবে জুলাই-আগস্টের সময়কাল থেকে আবার বেড়েছে গণপিটুনি। কারণ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক অব্যবস্থা, আইনশৃংখলা বাহিনীর দুর্বল কাঠামো এবং অপরাধীদের মুক্তি। সমাজে গত কয়েকবছর ধরেই বেড়েছে অসহিষ্ণুতা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোথাও সহনশীলতা নেই। এখানে কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তৈরি হয়েছে আইনের প্রতি অনাস্থা।
গুজব ও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে উন্মত্ত জনতা সন্দেহভাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। সন্দেহভাজনকে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে জনসাধারণ নিজেরাই বিচারের দায়িত্ব নিয়েছে, যা পুরোপুরি আইনবহির্ভূত বিষয়। বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাসের কারণে ঘটতে পারে মবোক্রেসি বা উচ্ছৃংঙ্খল গণবিচার। কিছু মানুষ মনে করেন, অপরাধীরা হয়তো আইনের আওতায় আসবে না বা উপযুক্ত শাস্তি পাবে না, তাই তারা নিজেরাই বিচার নিজে করার চেষ্টা করেন।
গণপিটুনির ঘটনায় প্রাথমিকভাবে যেসব মানুষ অংশ নেন, তারা সাধারণত যেকোনধরনের সামাজিক উত্তেজনা বা ক্ষোভের অংশ হয়ে থাকেন। অনেক সময় গুজব, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা রাজনৈতিক হিংসা মানুষের মধ্যে সহিংস প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে শত্রুতার অনুভূতি বেড়ে যায়, যা মানুষকে আরো হিংস্র করে তোলে। এখন আমরা ‘মবোক্রেসি’ বলতে যা বুঝি, এইটা তাই। "মব মেন্টালিটি" এমন একটি মনত্ত্বাত্বিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি ভিড়ের মধ্যে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এবং সবার সঙ্গে সহিংস কার্যকলাপে অংশ নেন, যা তারা একা কখনো করতে না। একে "ডিফিউশন অব রেসপন্সিবিলিটি" বলা হয়। যেখানে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে দায় ভাগ হয়ে যায়, এবং একক ব্যক্তির উপর দায় কমে যায়।
গণপিটুনি ঘটানোর পেছনে অনেক সময় গুজব এবং ভুল তথ্যের ভূমিকা থাকে। কেউ যদি গুজব শোনে বা ভুলভাবে ধারণা পায় যে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করেছে, তবে তারা সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েও গণপিটুনির মতো সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে যে স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা খুবই ভয়ের। যেকোনধরনের গুজব, ভুল তথ্য, অর্ধসত্য তথ্য মানুষকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে। গণপিটুনির ঘটনা প্রায়ই সেই ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয়, যারা অপরাধীকে মানুষ হিসেবে না দেখে, একটি "শত্রু" হিসেবে দেখেন। এতে তারা সহজেই সহিংসতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এছাড়া দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, হতাশা বা ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা থাকা মানুষও অনেক সময় গণপিটুনির মতো সহিংস কার্যকলাপে অংশ নিতে পারে।
সাধারণত অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ভয়, গুম-আতঙ্ক জনসাধারণকে আইনের প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। এই আস্থাহীনতা থেকে অনেকসময় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেন। আর সাইকোপ্যাথরা যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেন, তখন তা হয় ভয়াবহ। কারণ মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে গণপিটুনি ছাড়াও নানা ধরনের ভয়াবহ সব অপরাধ ঘটতে পারে।
আমাদের সমাজেও দেখছি হত্যার পর মৃতদেহ ১০ টুকরো করতে, ধর্ষণের ভিডিও আপলোড করতে, ব্যাগে করে শ্বশুরের মাথা নিয়ে ঘুরতে, কাটা মাথা বা পা নিয়ে উল্লাস করতে, ব্যক্তিকে গাছে ঝুলিয়ে গণপিটুনি দিতে দিতে গান করতে, কবরে আগুন দিতে, ঘোড়ার পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করতে, অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারের আগেই মারধোর করতে। এগুলো সবই গণমনোবিকারের স্পষ্ট লক্ষণ।
যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া হয় না, গণ-আসামীরা যখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় না, তখন সমাজের সেই উন্মত্ত অংশ আরো বেশি করে গণপিটুনির মতো অপরাধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ধর্ম অবমাননা, ছেলেধরা, ডাকাত, চোর, ফ্যসিস্টের দোসর, পাগল ইত্যাদি বলে যাকে খুশি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ কারণেই ৮ মাসে ১০০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
চার্লস-মারি গুস্তাভ লে বন একজন ফরাসি পলিম্যাথ। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ’দ্য ক্রাউড: এ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড’ বইতে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন ভিড়ের মনোবিজ্ঞান বা মনত্ত্বত্ব বিষয়টিকে। বইটিতে, লে বন বলেছেন ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া মানুষের মনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন: "আবেগ, বিরক্তি, যুক্তিতে অক্ষমতা, সমালোচনামূলক আত্মার বিচারের অনুপস্থিতি, অনুভূতির অতিরঞ্জন এবং অন্যান্য”। তিনি বলেন, "একজন ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যায় এবং শীঘ্রই নিজেকে খুঁজে পায়। ভিড়ের চৌম্বকীয় প্রভাবের ফলে বা এধরনেরই অন্য কোন কারণে ভিড়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তি সম্মোহিতের মতো আচরণ করেন এবং সেই সম্মোহিত ব্যক্তি নিজেকে একসময় নিজেকে হিপনোটাইজারের হাতে খুঁজে পান।"
অনেক একা মানুষ যখন কোনো মুহূর্তে এক হয়ে যায়, তখন তাদের মন মোটেও একলা মানুষের মনের মতো থাকে না। তার মন তখন ঠিক চেতন থাকে না। সব মানুষ মিলে কেমন এক বিশাল মনের মতো কাজ করে। তাদের সিদ্ধান্তও হয় অন্যরকম। গুস্তাভ এই ভিড়কে পছন্দ করেননি। একে তাঁর মনে হয়েছিল কোনো আদিম প্রাণীর মতো। বিশাল, তার শরীর অতিকায়। কিন্তু বোধবুদ্ধি, যুক্তি বলে কিছু নেই। (সূত্র: মানুষ থেকে জনতা আর ভিড়ের মনোবিদ্যা: জাভেদ হুসেন)
এই ভিড়ের মানুষগুলো একসময় আলাদা আলাদা মনোভাব প্রকাশ করলেও, যখন তারা ভিড়ের মধ্যে মিশে যান, তখন তারা এক রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে যান। এমতাবস্থায় সেই একই প্রশ্ন মনেহয়, কেন এমনটি হয়? মানুষ কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়? সে আসলে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে? কেন তারা এতোটাই ক্ষুব্ধ যে মানুষ মারতে হাত কাঁপে না? আসলে গণপিটুনি হলো একটি সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যা। সাধারণত যা ঘটে আইন বা বিচারব্যবস্থার অবহেলা বা আস্থাহীনতার কারণে। এই ঘটনা সাধারণত জনগণের রাগ বা ক্ষোভকে ভিত্তি করে ঘটে, এবং প্রায়ই অপরাধী হিসেবে সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়।
গণপিটুনি এমন একটি গুরুতর অপরাধ যা সমাজে অবিশ্বাস, ভীতি, অস্থিরতা, আইন অমান্য এবং নির্দোষ মানুষের প্রতি অবিচার সৃষ্টি করতে পারে। তাই এটি প্রতিরোধ করা দরকার কঠিনভাবে। নয়তো মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। মবোক্রেসি এমন এক ধরনের মধ্যযুগীয় মনোভাব সৃষ্টি করে, যেখানে আইন বা বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তে জনগণ নিজেদের "বিচার" বাস্তবায়ন করতে চায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণপিটুনির ঘটনা বার্তা দেয়, সমাজে আইন, বিচারব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জনগণের মনোভাব গভীর সংকটে আছে। এটি বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থাহীনতার চিত্র প্রকাশ করছে। কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা, বিচারিক সংস্কার এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে মবোক্রেসি রোধ করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে, মবোক্রেসি অপরাধ, কোন উল্লাস বা আনন্দের বিষয় নয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
মন্তব্য করুন