বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বিচারককে ডিম ছুড়ে কাকে ‘সন্তুষ্ট’ করতে চাইলেন আইনজীবী

সোহরাব হাসান
  ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:২৪
ছবি-সংগৃহীত

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে যে আশাজাগানিয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটা কতটা ধরে রাখতে পেরেছে, সে প্রশ্ন উঠেছে। আগে রাস্তাঘাটে সভা–সমাবেশে কারও সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, যাক, স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশটা রক্ষা পেল। তাঁদের কণ্ঠে একধরনের স্বস্তি ও তৃপ্তি লক্ষ করতাম। এখন জিজ্ঞেস করেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না কেন, দেশে হচ্ছেটা কী?

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানা রকম প্রস্তাব আসছে। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনগুলোও কাজ শুরু করেছে। এসব নিশ্চয়ই আশার দিক। কিন্তু হতাশার খবর হলো, সরকার জনজীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অবনতিশীল। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অঘটন ঘটছে।

অতি সম্প্রতি তিন কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ ও চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণী জোটের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন না হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য। এর আগে ছাত্ররা আগাম ঘোষণা দিয়ে পালন করলেন ‘সুপার সানডে’ ও ‘মেগা মানডে’। কর্মসূচির নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে গেল সবকিছু শেষ হওয়ার পর। আর চট্টগামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ঘটনায় যে ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে, সেটা ছিল অপ্রতুল। এ কারণে চিন্ময় অনুসারীরা একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারল।

অতীতে নিম্ন আদালতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজবীদের মধ্যে হট্টগোলের কথাও আমরা জানি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারকের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা এই প্রথম।

বুধবার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে (বিজয় ৭১ ভবনের ৩২ নম্বর আদালত) যা ঘটেছে, তা অবিশ্বাস্য। ৮ বছর আগে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ–সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ে তিন বিচারকের একজন ছিলেন বিচারপতি আশরাফুল কামাল। আর এ রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন—এমন অভিযোগ করে কয়েকজন আইনজীবী প্রথমে তাঁর উদ্দেশে কিছু মন্তব্য করেন। এরপর একজন আইনজীবী তাঁর দিকে ডিম ছুড়ে মারেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে ছুড়ে মারা ডিম বিচারপতির গায়ে লাগেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হইচই, হট্টগোলের মধ্যে বিচারপতি আশরাফুল কামাল ও বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলাম এজলাস ত্যাগ করেন।

উচ্চ আদালত হচ্ছেন মানুষের শেষ ভরসা। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আটকে রাখা যায়নি, তার অন্যতম কারণ উচ্চ আদালতের ন্যায়বিচার।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত হয়। পরে এ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রুল যথাযথ ঘোষণা করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ বলে রায় দেন।

আসাদুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ শীর্ষক এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি আশরাফুল কামাল বাংলায় দেওয়া তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকবাকুম করে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন, তথা রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একবারও ভাবলেন না, তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে তিনি আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন। ভাবলেন না তাঁর শপথের কথা। ভাবলেন না তিনি দেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করার শপথ নিয়েছিলেন।’ তিনি আরও কিছু মন্তব্য করেছেন, যা একজন বিচারক হিসেবে করতে পারেন কি না, সেই প্রশ্ন আছে।

কিন্তু তার জবাব দিতে হবে বিচারকের প্রতি ডিম ছুড়ে! কাজটি যিনি করেছেন, তিনি আইনজীবী হিসেবে তাঁর শপথ ভঙ্গ করেছেন।

এ ঘটনায় আদালত অঙ্গনে তোলপাড় অবস্থা তৈরি হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করলাম, একজন আইনজীবী কী করে বিচারককে ডিম ছুড়ে মারতে পারেন? তিনি বললেন, ‘পারেন না। আইনজীবী যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, আইনি পথে প্রতিকার চাইতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে নিজেই আইন হাতে তুলে নিলেন। এটা তো ফৌজদারি অপরাধ।’

ওই আইনজীবী জানালেন, বিষয়টি নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠদের সহায়তা পাননি বলে কিছু করতে পারেননি। তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি শক্ত পদক্ষেপ নিয়ছে বলে মনে হয়। সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানিয়েছেন, হাইকোর্টের এজলাসে ডিম ছুড়ে বিচারককে হেনস্তার ঘটনায় জড়িত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারককে হেনস্তার ঘটনায় জড়িত আইনজীবীদের বার কাউন্সিল সনদ বাতিল এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হবে।

এ ঘটনায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের জারি করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুধবার (২৭ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, তা অনভিপ্রেত, একই সঙ্গে দেশের জেলা আদালতগুলোতেও যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থতির সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।

এদিকে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং আদালতের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে দেশের প্রতিটি আদালত ও ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ, এজলাস, বিচারকদের বাসভবন, বিচারক–কর্মচারীসহ আদালত-সংশ্লিষ্ট সবার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধান বিচারপতি দেশের সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক স্মারকে এ তথ্য জানা গেছে।

উচ্চ আদালতে এ অঘটনের আগেও বেশ কিছু অঘটন ঘটেছে। সরকার কিংবা সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। ছাত্ররা দুবার সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘেরাও করেছেন দাবি আদায়ের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, সেখানে ঘেরাও করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। যেসব বিচারককে নিয়ে ছাত্ররা আপত্তি জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তদুপরি বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে প্রধান বিচারপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তো ছিলেন। এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হলো। ভবিষ্যতে অন্য কোনো গোষ্ঠী বা সংগঠন যদি মনে করে অমুক বিচারককে সরানো দরকার, তখন তো তারাও একই কাজ করবে।

এত দিন নিম্ন আদালতে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের হট্টগোলের কথা শুনেছি। নিম্ন আদালতে এরকম ছোড়াছুড়ির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু এবার খোদ উচ্চ আদালতে এক আইনজীবী বিচারকের প্রতি ডিম ছুড়ে মারলেন। যখন ওই মামলার শুনানি হয়, তখন তিনি প্রতিবাদ করলেন না কেন? একজন আইনজীবী হিসেবে তিনি তো জানেন, বিচারকের সঙ্গে এ আচরণ করা যায় না। তারপরও করেছেন। সেটি কি বিএনপির নেতৃত্বকে খুশি করতে? যখন দেশের উচ্চ আদালতে বিচারক অসম্মানিত হওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন মানুষের ভরসা রাখার জায়গা থাকে না।

মন্তব্য করুন