রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা: করণীয় কী

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
  ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪৪
ছবি-সংগৃহীত

দেশের অসংখ্য রাস্তায় চলাচল করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নির্মাণকাজ শেষ না করেই বা কাজ শেষ হবার আগেই ঠিকাদার লাপাত্তা হবার ঘটনা ঘটেছে। জনগণের ভোগান্তির কথা চারদিকে চাউর হলেও এর প্রতিকারের জন্য ত্বরিৎ কোনো ব্যবস্থা চোখেই পড়ছে না।

সরকারি-বেসরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। নানা কারণে অনেক নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হবার পূর্বে বন্ধ করে দেবার খবর পাওয়া যায়। তবে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে দেশে চলমান নির্মাণকাজগুলোর অনেক ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে অভিনব কিছু বিষয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় রাস্তা সংস্কার, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন তৈরি ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত অনেক ঠিকাদার চলমান কাজগুলো হঠাৎ বন্ধ করে দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে এই প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

তিন চার মাস আগেও ঘটা করে বলা হতো বলা হতো ‘সিটি করপোরেশন আগের তুলনায় সক্ষমতা অর্জন করেছে। কাউন্সিলর ও সংসদ সদস্যদের বরাদ্দ এ বছর থেকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা তাদের কল্যাণে বেশি ব্যয় করার কারণেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেড়েছে। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যথারীতি দরপত্র আহ্বান করা হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পুনঃদরপত্র বা একাধিক দরপত্র আহ্বান বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে ঠিক; কিন্তু প্রকল্পকে মানসম্পন্ন ও স্থায়িত্বশীল করা সম্ভব হয়নি।

আরো বলতে শোনা যেত ডিএসসিসির মেয়র বেশকিছু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনলেও প্রধান প্রকৌশলীসহ কিছু প্রকৌশলীর খামখেয়ালির কারণে এসব উন্নয়নকাজে ঠিকাদার সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া কাজ শেষ করার পরও বিল পেতে নানা সমস্যা, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকটসহ নানা কারণেই ঠিকাদাররা কাজে আগ্রহ হারিয়েছেন।

অসাধু ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশে যে কোনো নির্মাণ কাজে পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় অতিরিক্ত খরচ। এতে নির্মাণ কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও কোনো সমাধান আশা করা বৃথা ছিল।

গত পাঁচ আগস্ট থেকে গোটা দেশের নির্মাণ কাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্মাণকাজ শেষ না করেই ঠিকাদাররা তল্পিতল্পা গুটিয়ে আত্মগোপন করেছেন অথবা কাজের খরচের হিসাব দেবার ভয়ে লাপাত্তা হবার ঘটনা ঘটেছে। যারা মিলেমিশে রাজনীতি ও ঠিকাদারী করতে ব্যস্ত ছিলেন তাদের ভয়টা অতি বেশি।

দেশের বহু জেলা- উপজেলায় পাকা রাস্তা নির্মাণে ঠিকাদার প্রকৌশলী মিলেমিশে দুর্নীতি করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কাজ না করেই প্রায় ১৩-১৬ কোটি নিয়ে এখন লাপাত্তা। এ ছাড়া অসাধু ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা সারা দেশে প্রভাব খাটান। চট্টগ্রামে কাজ না করেই প্রায় ১৬ কোটি নিয়ে এখন লাপাত্তা। কাজ ফেলে পুরো টাকা নিয়ে ঠিকাদার লাপাত্তা কোথাও কোথাও ঠিকাদার রাস্তা ভেঙ্গে ফেলে রেখেছিল। মানুষ যাতায়াত করতে সমস্যায় পড়েছিল, একজন অটো চালক তার অটোতে ইট-পাথর নিয়ে এসে রাস্তাটিকে চলাচলের উপযোগী করে তোলেন।

নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার গায়েব হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় ঠিকাদার অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে বা পর্যাপ্ত তহবিল না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত আইনগত বা প্রশাসনিক জটিলতা থাকলে কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা দুর্নীতি বা অনিয়মের মাধ্যমে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে এবং কাজ শেষ না করে গায়েব হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি এসব কারণের একটাও একটাও ঘটেনি। তবুও নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার গায়েবের ঘটনা ঘটেছে দেশের বহু জায়গায়। তাদের গায়েব হবার রহস্য কি?

নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার গায়েব হওয়ার পিছনে থাকা "রহস্য" বলতে সেই সব কারণ বা পরিস্থিতিকে বোঝায় যেগুলো সরাসরি প্রকাশিত হয় না বা সাধারণ মানুষ সহজে জানতে পারে না। অনেক সময় ঠিকাদার সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্প থেকে অগ্রিম অর্থ পেয়ে প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা আত্মসাৎ করে। অর্থের গড়মিল বা দুর্নীতি আড়াল করার জন্য কাজ ছেড়ে চলে যায়।

কিছু ঠিকাদার রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত থাকতে পারে। রাজনৈতিক পালাবদল বা প্রভাব পরিবর্তনের সময়ও এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কখনও ঠিকাদারদের সাথে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গোপন চুক্তি থাকে। এই চুক্তির অংশ হিসেবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ বন্ধ করে বা দেরি করে।

যদি ঠিকাদার কাজ ছেড়ে চলে যায় বা গায়েব হয়ে যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ধরনের ঘটনার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা উচিত। ঠিকাদারের সাথে চুক্তিতে থাকা জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের ধারা প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা কাজের সময়সীমা মেনে চলে। বড় প্রকল্পগুলোকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে দেয়া উচিত এবং প্রতিটি ধাপ আলাদা ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে একটি ঠিকাদারের ব্যর্থতা পুরো প্রকল্পকে থামিয়ে দেবে না।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব মুক্ত করে উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে। ঠিকাদারদের উপর যদি স্থানীয় চাঁদাবাজি বা অপরাধী গোষ্ঠীর চাপ থাকে, তাহলে প্রশাসনকে শক্ত হাতে তা দমন করতে হবে। ঠিকাদারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা কাজ করতে ভয় না পায়। এই প্রতিকারগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে ঠিকাদারদের গায়েব হয়ে যাওয়া এবং রাস্তার নির্মাণকাজ ফেলে যাওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলি সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।

রাস্তার নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার গায়েব হয়ে কতদিন পালিয়ে বেড়াবেন? ঠিকাদাররা যদি রাস্তার নির্মাণকাজ ফেলে গায়েব হয়ে যান, তখন তারা কতদিন পালিয়ে বেড়াবেন, তা নির্ভর করে বেশ কিছু পরিস্থিতির উপর। যদি প্রকল্পের ওপর কোনো কঠোর নজরদারি না থাকে বা প্রশাসন কার্যকরভাবে ব্যবস্থা না নেয়, তবে ঠিকাদাররা দীর্ঘদিন ধরেই গায়েব থাকতে পারে এবং তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। দুর্নীতি বা নজরদারির অভাবে অনেক সময় তারা কাজ না করেও পার পেয়ে যায়।

এছাড়া যদি প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, তবে ঠিকাদারদের পালিয়ে থাকার সময় সীমিত হয়। তদন্ত, তল্লাশি, বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে কখনো কখনো মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে, যা তাদের পালিয়ে থাকার সুযোগ দেয়। যদি প্রশাসন এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকে, তবে ঠিকাদারদের জন্য দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। আইনি এবং সামাজিক চাপ তাদের ফিরিয়ে আনতে বা শাস্তির মুখোমুখি করতে সাহায্য করবে।

রাস্তার নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদার গায়েব হলে ধরার উপায় ও শাস্তির ধরন কি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। অন্তবর্তীকালীন সরকারে সময়ে ঠিকাদার গায়েব হয়ে যাওয়া ঠিকাদারদের ধরার অনেক উপায় রয়েছে। এজন্য প্রথমেই প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। চুক্তির শর্তাবলী লঙ্ঘনের জন্য মামলা দায়ের করা হতে পারে। আদালতের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যায়।

ঠিকাদার যদি গায়েব হয়ে যায়, তবে পুলিশ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্যে তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব। তদন্তের মাধ্যমে ঠিকাদারের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড- সম্পর্কে জানা যাবে। অনেক চুক্তিতে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানা ধার্য করার শর্ত থাকে। চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে ঠিকাদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সম্পত্তি বা অন্যান্য সম্পদ জব্দ করা যেতে পারে। এতে তাকে বাধ্য করা যায় আইনের আওতায় আসতে।

ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রকল্প শুরুর সময় জামানত হিসেবে কিছু অর্থ বা সম্পদ নেয়া হয়ে থাকে। যদি ঠিকাদার কাজ না করে গায়েব হয়ে যায়, তাহলে এই জামানত থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব। ঠিকাদারের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পেতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং, ইমেল, বা ব্যাংক লেনদেনের ট্র্যাকিং। এতে তার অবস্থান বা কার্যকলাপ চিহ্নিত করা সহজ হয়।

অন্তবর্তীকালীন সরকারে সময়ে ঠিকাদার গায়েব হয়ে যাওয়ার শাস্তির ধরন: কি হওয়া দরকার? ঠিকাদারের চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাকে আর্থিক জরিমানা করা যেতে পারে। কাজ শেষ না করে চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতির জন্য তাকে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করা হয়। ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রতারণা, দুর্নীতি, বা জনগণের সম্পত্তি অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

রাস্তার নির্মাণকাজ ফেলে ঠিকাদারদের গায়েব হয়ে যাওয়ার প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ঠিকাদারের সঙ্গে থাকা চলমান চুক্তি বাতিল করা হতে পারে এবং ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্পে অংশ নিতে তাকে নিষিদ্ধ বা কালো তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। চুক্তি লঙ্ঘন বা দুর্নীতির কারণে ঠিকাদারের ব্যক্তিগত বা কোম্পানির সম্পত্তি জব্দ করা হতে পারে।

এসব উপায় ও শাস্তির মাধ্যমে ঠিকাদারদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও গায়েব হয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমানো এবং উন্নয়নমূলক কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু তাতে কি ফেলে রাখা কাজ সম্পন্ন করা যাবে? এই নৈতিক প্রশ্ন সবার সামনে রাখলাম। কারণ আমরা এখনও সৎ মানুষ হইনি!

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

মন্তব্য করুন