বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মহাসড়ক অবরোধ না করলে আন্দোলনের ফল পাওয়া যায় না কেন?

শাহানা হুদা রঞ্জনা
  ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২

ট্রাফিক এলার্ট পেজটি যারা ফলো করেন, তারা লক্ষ করেছেন যে ঢাকার অন্য সড়কের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই মানুষ জানতে চাইছেন ঢাকা-ময়মনসিংহ-গাজীপুর-টঙ্গী মহাসড়কের অবস্থা কি স্বাভাবিক? নাকি যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে? কারণ গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধের কারণে কয়েকদিন ধরেই মানুষ দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকছেন এই এলাকায়। বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ হেঁটেই গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হয়েছেন।

অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসছিলেন ফয়জুল আলম। বাসে আসতে সময় লাগবে ৩-৪ ঘণ্টা, এই ভেবেই বাসে করে আসছিলেন। কিন্তু সড়ক অবরোধের কারণে প্রায় ৯-১০ ঘণ্টা আটকে ছিলেন। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে অসহায় হয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছিলেন বিলকিস বেগম। উনি তার মেয়েকে নিয়ে ফুলপুর গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন সকাল ৭টায়। দুপুর ১২-১টার মধ্যে পৌঁছানোর কথা থাকলেও, সন্ধ্যা ৭টা বেজে গিয়েছে ঢাকা পৌঁছাতে। পথে বাথরুম না থাকায় ওনাকে খুব কষ্ট পেতে হয়েছিল।

গাজীপুরে একেক সময়, একেক কারণে শ্রমিকরা কেন বিক্ষোভ করছেন উল্লেখ করে শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমারও একই প্রশ্ন, বেতনের দাবিতে সড়ক কেন অবরোধ করেন তারা? শ্রমিকরা ইচ্ছা করলে বিজিএমইএ ভবনে যেতে পারেন। কারখানায় আন্দোলন করতে পারেন। হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা ঠিক হচ্ছে না।’ (প্রথম আলো)।

কেন শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেন? পোশাকসহ অন্য শ্রমিকদের অবরোধে সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়, মানুষ অসুবিধার মধ্যে পড়ে, জরুরি কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, শিশু ও নারীরা ভয়াবহ ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। অনেক সময় এই চাপ ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অবশ্য শুধু শ্রমিকরাই নন, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী সবাই প্রতিবাদ জানাতে সড়ক অবরোধ করেন।

সড়ক অবরোধ করার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে যে এর ফলেই প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা। সাধারণ মানুষের অসুবিধা হলে কর্তৃপক্ষ ও সরকার দ্রুত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। মহাসড়ক অবরোধ একটি গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। এ ধরনের অবরোধ কেবল সাধারণ জনগণের যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

যাক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি, দেশের বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে প্রায়শই সড়ক অবরোধ করেন। তাদের দাবির মধ্যে আছে নিয়মিত বেতন, উৎসব ভাতা, বেতন বৃদ্ধি, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি এবং এর কোনো দাবিই অযৌক্তিক নয়। এগুলো না পেলে মালিকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার জন্য পথে না নেমে কোনো উপায় থাকে না।

পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্প। সরকার এবং অধিকাংশ মালিক চেষ্টা করেন এই শিল্প বড়ধরনের বাধা ছাড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে। এরপরও মাঝে মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়, শ্রমিক অসন্তোষ হয়। যেমন জুলাই-আগস্টের বিপ্লব, সরকার পরিবর্তন, মালিক পরিবর্তন, কারখানার মালিকের অনুপস্থিতি, রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা অস্থির হওয়ার ফলে শিল্পকারখানার ওপর চাপ পড়ে। এই চাপ সামলাতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা এসে লাগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাপ্রপ্তির ওপর। এজন্যই বিভিন্ন শিল্প এলাকায় পাওনা না পেয়ে বারবার সড়কে নামছেন শ্রমিকরা।

‘কারখানা মালিক বেতন-ভাতা না দিলে সড়ক অবরোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না আমাগোর’- এ কথা স্পষ্টভাবে বললেন জলিল মিয়া। তিনি কাজ করেন গাজীপুরের একটি কারখানায়। সড়কে কেন আন্দোলন করছেন, জবাবে আরেকজন শ্রমিকও একই কথা বলেন, ‘হোনেন, দেশের কোনো আন্দোলনই সড়কে না করলে ফল পাওয়া যায় না। আমরা সড়ক বন্ধ করছি আপনারা দেখাইতেছেন, ওপরের অফিসারও দেখতাছে। এহন দেখবেন ঠিকই একটা সমাধান হবে।’ সড়ক কখন ছেড়ে দেবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না বেতন পামু, ততক্ষণ ছাড়তাছি না। খাইয়া, না খাইয়া এবার নামছি। বেতন নিয়াই বাড়িতে যামু।’ (প্রথম আলো)

একথা সত্যি যে প্রথমে কারখানার ভেতরই শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। সেগুলোতে মালিকপক্ষ পাত্তা না দিলে শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার সামনে ও পরে মহাসড়কের বিক্ষোভ করেন। দেখা গেছে সবসময়ই পাওনা না পেয়ে সড়কে নেমেছেন শ্রমিকরা। কেবল পোশাক শিল্প নয়, বহু বছর ধরে উৎপাদন চালু থাকা ওষুধ শিল্পেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শ্রমিকরা নানান দাবি জানান, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এবং একপর্যায়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এখন কারখানাগুলোতে একেক এলাকায় একেক দাবি উঠছে। কারখানায় দেওয়া হচ্ছে দাবিনামা। কারা দাবিনামা দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নাকি শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ করেই তৈরি শিল্প শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কিছু অদ্ভুত দাবি উঠছে। যেমন- নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা সমান হতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প বড় হয়ে ওঠার পর থেকেই নারী শ্রমিকের প্রাধান্য ছিল, কখনো এ নিয়ে আপত্তি ওঠেনি। দ্বিতীয়ত গত জানুয়ারি থেকে নতুন মজুরি কাঠামো মেনে নিয়েই কাজ চলছে, সাত মাস যেতে না যেতেই বেতন বাড়ানোর দাবি উঠছে, মজুরি কাঠামোতে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ আছে, এবার সেই বেতন বৃদ্ধি ১৫ শতাংশ করার কথা বলা হচ্ছে, এমন কথাও কেউ কখনো শোনেনি। (বিডিনিউজ.কম)

প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বলা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। অবরোধ ছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল।

গত বছর শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও আসে। তবে বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষ খরচ কমানোর জন্য ধীরে ধীরে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেন। ছাঁটাই করা শ্রমিকরা পরে আর চাকরি ফিরে পাননি। সরকার পরিবর্তনের পর তারাই কারখানাগুলোয় জড়ো হয়েছেন চাকরি ফিরে পেতে। এছাড়া মালিক-শ্রমিক দূরত্ব তো আছেই। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন এবং চাপ দিচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। অথচ এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে কিছু করারও নেই।

খবরে দেখলাম বিক্ষোভ ও আন্দোলনের সুযোগে কারখানা ভাঙচুর ও লুটের চেষ্টাও হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। আন্দোলনের পর বিভিন্ন কারণে পুলিশের সক্ষমতা ও সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কাজেই এমন সময়ে শ্রমিক বিক্ষোভ অনেকটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পোশাক শিল্পের বাইরেও বিভিন্ন ওষুধ কারখানা, জুতা কারখানার শ্রমিকরাও নানান দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন।

সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে রাখলেই দাবি আদায় হবে, শ্রমিকদের মাথা থেকে এ ধারণাটা সরাতে হবে। অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের অবরোধের প্রবণতা কমে আসে। মারামারি নয় কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।

ট্রাফিক মনিটরিং সিস্টেম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সড়ক অবরোধের বিষয়ে দ্রুত তথ্য পাওয়া এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতে পারে। আন্দোলনকারীদের যদি সড়ক অবরোধের বদলে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বা মিছিল করার জন্য উৎসাহিত করা যায়, তবে সড়ক অবরোধের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।

এই দেশে শ্রমিকের জীবন এতটাই মূল্যহীন যে তাদের নিরাপত্তা, বাসস্থান, শিক্ষা, কাজের সুযোগ, আরাম-আয়েশ সবই গৌণ, শুধু দু’মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। অথচ শ্রমিকদের পক্ষে এই দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মালিকরা যা আয় করেন, এর সামান্যই শ্রমিকদের ভালো থাকার পেছনে ব্যয় করেন। মালিকপক্ষ যত দিন না শ্রমিকদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেবেন না এবং শ্রমিকরা যত দিন তাদের অধিকারের দাবি মালিকের সামনে তুলতে ভয় পাবেন, তত দিন এভাবে রাস্তা অবরোধ করেই দাবি মেটানোর চেষ্টা করবেন। কারণ তারা লক্ষ্য করেছেন, যে যাই বলুক, আসলে তাদের পাশে কেউ নেই। তাই নিজেদেরই পথ খুঁজতে হয়, আর সেই পথ হলো মহাসড়ক অবরোধ।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন