যে জাতি স্বপ্ন দেখতে জানে না, যে জাতি জেগে উঠতে জানে না, সেই জাতি কখনও উন্নতির পথে হাঁটতে পারে না। নব জাগরণ মানে শুধু নতুন সূচনা নয়, বরং নিজের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এটি একটি পুনর্জন্ম, একটি জাতির আত্মা জাগ্রত হওয়ার মুহূর্ত। কিন্তু আজ আমাদের প্রশ্ন—এই মুহূর্তে, সত্যিই কি আমরা সেই নব জাগরণের পথে আছি?
স্বৈরাচারের পতন, কিন্তু নতুন ভোর?
তিন মাস আগেও আমাদের দেশ ছিল স্বৈরাচারী শাসনের মুঠোবন্দি। মানুষের স্বপ্ন পদদলিত হচ্ছিল, বাকস্বাধীনতা ছিল রুদ্ধ। সেই শাসকের পতন ঘটিয়ে জাতি এক নতুন সূর্যের অপেক্ষায় ছিল। সবাই ভেবেছিল—এবার হয়তো মুক্তির পালা শুরু হবে। কিন্তু আজ, আমরা দেখছি ভিন্ন এক চিত্র।
রাস্তায় এখনও রক্তের দাগ শুকায়নি। গুম হওয়া মানুষগুলো ফেরেনি। হাসপাতালের শয্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছেন। সেই শাসকের জায়গায় আজ নতুন মুখ, কিন্তু শোষণের ছায়া রয়েই গেছে। শুধু নাম বদলেছে, কিন্তু বাস্তবতা বদলায়নি।
‘চোরে খেয়েছে তুধকলা এবং তাঁদেরই বড় গলা’
আমাদের রাজনীতির বাস্তবতা যেন সেই চিরন্তন প্রবাদের প্রতিচ্ছবি—‘চোরে খেয়েছে তুধকলা এবং তাদেরই বড় গলা।’ যারা একদিন শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাদের অনেকেই আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন।
দুর্নীতি এখন আরও কাঠামোবদ্ধ হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার আরও নির্লজ্জ। যারা একদিন সাধারণ মানুষের আশার প্রতীক ছিলেন, তারাই আজ শোষকের নতুন চেহারা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
জাতি কেন বিভ্রান্ত?
মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলো ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। কেন? মানুষ কি পথভ্রষ্ট? নাকি তাদের সুকৌশলে বিভ্রান্ত করা হয়েছে?
গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, শাসকের চাতুর্য আর ন্যায়বিচারের অভাবে মানুষ ক্রমে বিশ্বাস হারিয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে জাতির চেতনাও একদিন নিস্তেজ হয়ে যাবে।
বিভাজনের রাজনীতি ও চেতনাহীন সমাজ
একটি জাতিকে দুর্বল করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো বিভাজন। আমাদের সমাজেও ধর্ম, রাজনীতি এবং জাতিগত পার্থক্যের নামে মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। এই বিভাজন শুধু জাতিকে দুর্বল করেনি বরং তাদের স্বাধীন চিন্তার সামর্থ্যকেও গ্রাস করেছে।
আরও এক দুঃখের গল্প
অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষের আর্তনাদ আজও থামেনি। গ্রামে, শহরে—অসহায় মানুষের চোখে এখনও হতাশার ছায়া। চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু, ক্ষুধার যন্ত্রণা, কিংবা দারিদ্র্যের চাপে স্বপ্নহীন মানুষের আর্তনাদ কারও কানে পৌঁছায় না।
জাগরণের পথে করণীয়
আমাদের নব জাগরণ কেবল একটি স্লোগান হয়ে থাকবে না, যদি আমরা এর মর্মার্থ বুঝি। এটি তখনই সফল হবে, যখন আমরা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেব।
১. গণচেতনা বৃদ্ধি: মানুষকে তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
২. দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা: স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
৩. মানবিক মূল্যবোধ চর্চা: ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিকতা এবং মানবিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।
৪. শিক্ষার বিস্তার: এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা দরকার যা শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি করবে।
৫. সামাজিক ঐক্য: বিভেদের রাজনীতি ভেঙে ঐক্যের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শেষ কথা: জেগে ওঠার ডাক
নব জাগরণ মানে শুধু পুরনো শাসকের পতন নয়, এটি একটি জাতির আত্মশুদ্ধির আহ্বান। এটি আমাদের শেখায়, সত্যিকারের পরিবর্তন আসে তখনই, যখন আমরা নিজেদের ভেতরের অন্ধকারকে জয় করি।
আজ যারা শোষণের শিকার, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা ন্যায়বিচার চায়, তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতে হবে। একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে শোষণ আর প্রতারণার চক্র ভেঙে ফেলা যায়।
আমাদের সামনে হয়তো আরও অনেক বাধা আসবে। কিন্তু সেই বাধা অতিক্রম করার জন্য চাই সাহস, ঐক্য আর দৃঢ়তা। নব জাগরণ মানে একটি নতুন সূচনা। সেই সূচনা হোক আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে, আমাদের প্রতিদিনের কাজে।
টুমরো উইল নেভার ডাই, টুডে উইল নেভার কাম। মোমেন্ট ইজ হিয়ার, সো থিংক এন্ড ডু ইট নাও।
জেগে উঠুন, এগিয়ে চলুন—আজকেই হোক সেই নতুন দিনের সূচনা!
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
([email protected])
মন্তব্য করুন