মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মুনতাহাদের জন্য এই দেশ নিরাপদ হবে কবে?

শাহানা হুদা রঞ্জনা
  ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২০:১১
ছবি-সংগৃহীত

ফুটফুটে মেয়ে মুনতাহা। ৩ নভেম্বর ২০২৪ থেকে সে নিখোঁজ। ফেসবুকে কয়েকদিন ধরে ওর হারিয়ে যাওয়ার খবরটি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সবাই প্রার্থনা করছিলেন মুনতাহা যেন গোলাপি ফ্রকটি পরেই বাবা-মায়ের বুকে ফিরে আসে। কিন্তু তা আর হলো না, মুনতাহা ফিরে এলো শবদেহ হয়ে। তাকে হত্যা করে গলায় দড়ি বেঁধে বাড়ির পাশে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেছিল ওর পরিচিতজন। ১০ নভেম্বর ২০২৪ ভোররাতে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

অভিযোগ উঠেছে শিক্ষিকা ও তার পরিবারের প্রতি। মুনতাহার খবরটি শুনে অনেকেই মন্তব্য করেছেন আহা এতটুকু একটা বাচ্চাকে মানুষ মেরে ফেলে কেমন করে? হ্যাঁ, দেখতে-আকৃতিতে মানুষই শিশু হত্যা করে, মানুষই শিশুকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করে। শিশু সবচেয়ে দুর্বল বলে অব্যাহতভাবে ঘরে-বাইরে তারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আর মুনতাহা তো একা নয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫৪ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের ৭৭ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছর, ২৬৭ জন ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী। আর একই সময়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে আরও ৫২১ টি শিশু (আইন ও সালিশ কেন্দ্র)।

অক্টোবর মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে আলোচিত ছিল রাজধানীর বনানী এলাকায় নিম্নবিত্ত পরিবারের ৯ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা। এ ঘটনায় শিশুর মাসিক ও মলত্যাগের রাস্তা এক হয়ে গেছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ বছরের গৃহকর্মী কল্পনাকে। বাসার মালিক তাকে নির্যাতন করতো। কল্পনাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তার সামনের চারটি দাঁত ভাঙা, সারা গায়ে মারধর ও ছ্যাঁকার ক্ষত ছিল। এছাড়া বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণের অভিযোগ তো আমরা অহরহ শুনছি।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১ শতাংশ। নারী ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শিশু ধর্ষণের মোট ঘটনার প্রায় ৭৪ শতাংশ ঘটেছে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগে। এগুলো প্রতিবেদনে প্রকাশিত হওয়া সংখ্যা। এর বাইরে রয়েছে আরও অসংখ্য।

দেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এরকম কতগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে বা যাচ্ছে। যেমন শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা কম উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এদিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলালেও নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র আগের মতোই রয়ে গেছে।

এক বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের নারীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। সারা দেশে অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার মাত্র কয়েকটি উদাহরণ উঠে আসে বা আমরা জানতে পারি। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। মামলার অর্ধেকই ধর্ষণ ও ধর্ষণে চেষ্টার অভিযোগে করা হয়েছে।

কেন শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা এবং সহিংসতা সমাজে বাড়ছে? কেন বাড়ছে এর কোনো সদুত্তর নেই। রাষ্ট্র, সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মানবাধিকার সংগঠন কি তবে শিশু হত্যা, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ ইস্যুকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে না?

এইসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি এবং হত্যা কমানো যাচ্ছে না। এছাড়া সাক্ষীর অভাব, ভিকটিমের পরিবারের দরিদ্রতা, সামাজিক লজ্জা, ভয়-ভীতি, ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয় এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একসময় শিশুর ধর্ষণ ও হত্যা মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে। বিচার ও শাস্তি ছাড়াই আসামি পার পেয়ে যায়।

নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধগুলো আমরা কীভাবে ঠেকাতে পারি? শিশুর প্রতি অপরাধ যে, একটি ভয়ংকর অপরাধ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যে একে প্রতিরোধ করা দরকার এই বোধ যতদিন সমাজে গড়ে না উঠবে, ততদিন এই অপরাধ কমবে না। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা জরুরি; পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বন্ধন শক্তিশালী করা, জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সভ্য দেশগুলোয় শিশুকে নিরাপদ রাখার জন্য তাদের কথার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু যে মূল্যবান এই বোধ তৈরি করা হয় শিশুর মধ্যে। বাবা-মা ও অভিভাবকের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে শিশু মন খুলে তার অভিযোগ ও মনোভাব জানাতে পারে।

শিশুর সাথে দুর্ব্যবহার করলে বা শিশু মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ আইন আছে। সেখানে অপরাধের জন্য শিশুকে দায়ী করা হয় না। উন্নত দেশে মনে করা হয় মানসিক নির্যাতন হলো শিশুর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। আর শারীরিক নির্যাতনও তাই।

কোনোভাবে যদি শিশু বাবা-মা অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দ্বারা নির্যাতিত হয় বা প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সেবা ও দেখাশোনার কাজে অবহেলার শিকার হয়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। শিশুকে রক্ষার জন্য সভ্য দেশগুলো আইন প্রণয়নে যতটা কঠোর ও সচেতন, আমাদের মতো দেশগুলো তা নয়। বরং উল্টোটাই ঘটে বলা যায়।

শিশু অপরাধের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না কঠোর হবে, সরকার যতদিন না শিশুর পক্ষ হয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, ততদিন আমাদের শিশুরা এইভাবেই নিপীড়িত হতে থাকবে।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দেবী’। সেই চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে কয়েকজন নারী বসে আছেন একটি ঘরে। এনারা কেউ একে অপরের পরিচিত নন। এখানে আছেন মুসলিম, মারাঠি, গুজরাটি, বয়স্ক, পেশাজীবী, ছাত্রী, গৃহিণী, কিশোরী এবং তরুণী। এই মেয়েগুলোর মধ্যে মিল একটাই, তা হলো, এরা প্রত্যেকেই জীবিত অবস্থায় ধর্ষণের ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আজ সবাই তারা মৃত।

যে জায়গাটায় এরা গা ঘেঁষে বসে কাঁদছেন, গল্প করছেন, কুঁকড়ে আছেন সেই জায়গাটি খুব ছোট পরিসরের। সেখানে এই মেয়েগুলো প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনের গল্প বলছেন। তারা জানেন নারীর পোশাক, বয়স, পেশা, চেহারা, ধর্ম ও সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, তিনি ধর্ষণের শিকার হতে পারেন।

‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি ভারতে নির্মিত হলেও বাংলাদেশেও প্রতিটি জেলাতে একেকটি ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের গল্প লুকিয়ে আছে। আমরা শুধু তাদের গল্প দেখাতে পারছি না। চলচ্চিত্রে ঘরবন্দি সেই মৃত নারী ও শিশুরা আর কেউ নয় আমার মা, আমার বোন, আমার সন্তান এবং আমাদের মুনতাহারা।

শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন