কোভিড মহামারি থেকে বিশ্ব এখন বেরিয়ে এলেও অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব এখনো বিরাজমান। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। এসব কারণে তীব্র জ্বালানি সংকট, খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মতো সমস্যার সাথে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি হলো, একটি অর্থনীতিতে পণ্য ও পরিসেবার দামের একটি সাধারণ বৃদ্ধি। অর্থাৎ দ্রব্য বা সেবার দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ দ্রব্য বা সেবা কিনতে বেশি পরিমাণ মুদ্রা খরচ করতে হয় বা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে দ্রব্য বা সেবা কিনতে গেলে আগের চেয়ে কম পরিমাণ পাওয়া যায়।
আধুনিক অর্থনীতি, দেশে সবসময় একটি স্বল্প কিন্তু স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মতামত দেয়। কারণ স্বল্পমাত্রার ও স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনীতির সূচকগুলো সচল রাখে এবং এর বাজারগুলো বিভিন্ন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সচল ও স্থিতিশীল রাখে।
অন্যদিকে সরকারের সম্প্রসারণমূলক উন্নয়ন নীতি, বেতন বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট পূরণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানো ইত্যাদি নীতির ফলে সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে (demand-pull) চাহিদা প্রভাব ধরনের মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
কোনো দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ছাপানো মুদ্রার পরিমাণ অনেক বেশি হলে মুদ্রার একক মান হ্রাস পায়, মূল্যস্ফীতি ঘটে। এছাড়াও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, নতুন বেতন স্কেল প্রদান, প্রশাসনিক খরচ বৃদ্ধি, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, সহজ শর্তে বেশি পরিমাণ ঋণ ছাড়করণের নীতি, খাদ্য ঘটতি, চোরাচালান, হুন্ডি, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা—এসব মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
মূল্যস্ফীতির ফলে নগদ অর্থের ব্যয় কমে যায়। মানুষ নগদ অর্থের সঞ্চয়ের পরিবর্তে খরচ করে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়ের অভাবে ভোগে এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে আসে। এছাড়াও কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক উৎপাদন খরচের ওপর এর প্রভাব পড়ে।
এমন অবস্থায় উৎপাদন কমার আশঙ্কা দেখা দেয়। উৎপাদন কমে গেলে অনেকের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা থাকে। মুদ্রাস্ফীতি সমাজে আয় বণ্টনের বৈষম্য করে, অর্থনীতিতে একটা সার্বিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মূল্য কমে যায় এবং স্থির আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের প্রকৃত হার পুনরায় নিরূপণ করতে হয়।
তাই সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি থাকলে সেটাকে সহনীয় বলা যায় কিন্তু তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশ হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এবং এর চেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে চাহিদা ও জোগানের অসমতাই মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগসংক্রান্ত কোনো কারণে পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে (cost-push) ব্যয় প্রভাব মূল্যস্ফীতি ঘটে।
অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে যে ঋণ নিয়েছে সে লাভবান হয় এবং পাওনাদার বা ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে, তারা এই সময়ে লাভবান হয়, কারণ শেয়ারের দাম বাড়ে কিন্তু যারা নির্দিষ্ট সুদের হারে গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি বা ডিবেনচারে বিনিয়োগ করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অর্থনীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হার ও সুদের হার—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ ব্যাপার নয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় জড়িত থাকে।
আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও পরিমিত মূল্যস্ফীতির মতো সূচক। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে লাগামহীনভাবে বাড়ছেই বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। পণ্যের দাম বাড়লেও সেই হারে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, যার ফলে এখন নিম্ন আয়ের মানুষই শুধু নয়, মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী পণ্য মূল্যের গতিবিধি, অভ্যন্তরীণ আর্থিক ও মুদ্রানীতির অবস্থান এবং বিনিময় হারের অস্থিরতা থেকে উদ্ভূত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক জানুয়ারি ২০২৩-এ প্রকাশিত ‘Inflation peaking amid low growth’ শীর্ষক প্রতিবেদন মোতাবেক বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালের ৮.৮ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ৬.৬ শতাংশে এবং ২০২৪ সালে ৪.৩ শতাংশে নেমে আসবে বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্ক টপকে ১১.৬৬ শতাংশ; যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.১ শতাংশে দাঁড়ায়।
১৩ বছরে এটা সর্বোচ্চ। বিবিএসের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের কষ্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ মাসে গ্রামের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৮৯ শতাংশ, যেখানে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১.২৭ শতাংশ। তবে গ্রাম এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি শহর এলাকায় ছিল সবচেয়ে বেশি।
গ্রাম এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.০৬ শতাংশ, যেখানে শহর এলাকায় তা ছিল ১৪.২২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৯২ শতাংশে এসেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরেই আছে।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় যাদের রিজার্ভ কম, তাদের জ্বালানি আমদানিতে উচ্চ মূল্য দিতে হয় তাই ডলারের ঘাটতি হয় এবং এর জন্য আমদানি ব্যয় বাড়ে। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে রয়েছে। এটা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও রয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিলেও এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি কমেছে কিন্তু বাংলাদেশে কমেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.১ শতাংশ। সেটি কমে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৮.১৯ শতাংশ হলেও ২০২৪ এর জানুয়ারিতে হয়েছে ৫.৩ শতাংশ।
সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায় শ্রীলঙ্কার নাম। দুই বছর আগে দেশটি দেউলিয়া হলেও সেখান থেকে উঠে এসেছে। অর্থনীতিকে চাঙা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে মুদ্রানীতি কঠোর করে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছে, সরকার কৃচ্ছ্রতা সাধন করে বাজেট ঘাটতি কমিয়েছে, বার্ষিক ঘাটতি কমাতে ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে, ঋণ পুনর্গঠন করেছে।
ফলে শিল্প ও কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদন বেড়েছে। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো পদক্ষেপও নিয়েছে। একই সাথে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৯ শতাংশের বেশি কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই হার এসে দাঁড়ায় ৬.৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে জোর দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি রোধে উদ্যোগ, টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশ কতটা কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে পারে। দেশের ব্যয় সংকোচন খুবই কঠোর হাতে করতে হবে। এখন যদি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা যায়, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, সংকোচন নীতি ধরে রাখা যায়, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইন প্রণেতাদের দিক থেকেও শক্তিশালী উদ্যোগ নেওয়া যায়, ডলার সংকট কাটানো যায়, তাহলে আশা করা যায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
রুনা সাহা ।। সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন