বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

স্পেনের বন্যা বিপর্যয় এবং বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় দিক

রহমান মৃধা|
  ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ | GMT +6
ছবি-সংগৃহীত

১৯৮২ সালের ২০ অক্টোবর, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় ‘পানতানাদা দে তউস’ জলাধারটি ধসে পড়ে লা রিবেরা এলাকায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। এতে ৪০ জন প্রাণ হারায় এবং বহু মানুষ তাদের সম্পদ হারায়। আন্টোনিও বার্সেলো, যিনি সুইডেনের রয়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (KTH) থেকে শিক্ষাগ্রহণ শেষে দেশে ফিরে গবাদি পশু পালনের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন শুরু করেছিলেন, সেই বিপর্যয়ে তার সম্পূর্ণ ব্যবসা হারান। তার প্রায় একশো কানাডিয়ান গাভী মারা যায়, যা তার জীবিকায় বড় আঘাত হানে। এবারের (২০২৪ সাল) দুর্যোগে আন্টোনিওর শহরটি আবারও বড় ধাক্কা খেলো। প্রসঙ্গত, আন্টোনিও বার্সেলো আমার স্ত্রী মারিয়া বার্সেলোর বাবা।

সম্প্রতি, স্পেনের দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে, যা মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং অসংখ্য বাড়িঘরকে পানির নিচে ডুবিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ভ্যালেন্সিয়া প্রদেশে এই বিপর্যয় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যেখানে ৯২ জনেরও বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৭ জনে। ভ্যালেন্সিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্লোস মাজন বলেছেন, ‘পরিবারগুলোর প্রতি সম্মান রেখে আমরা আর কোনো তথ্য প্রকাশ করব না।’

প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তির এই যুগে স্পেনের মতো উন্নত দেশে এমন ব্যর্থতা কীভাবে সম্ভব? এটি শুধু স্পেনের নয় বরং বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের একটি পরিচিত চিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সঠিক তথ্যের অভাবে প্রশাসন কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়। স্পেনের ঘটনাটির মাত্রা এবং জনগণের ক্ষোভ এ ব্যর্থতারই প্রতিফলন।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও প্রতি বছর ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয় এবং প্রায়ই দেখা যায় যে সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। স্পেনের বিপর্যয় মূলত প্রবল বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের কারণে মালাগা থেকে পূর্বের ভ্যালেন্সিয়া পর্যন্ত বিশাল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পরিচিত ‘দানা’ নামে আবহাওয়ার এই ঘটনা পরিচিত হলেও এবারের পরিস্থিতি ছিল অভূতপূর্ব। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এসব দুর্যোগের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি শিক্ষা যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা জরুরি।

মেটিওরোলজিক্যাল কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ স্তরের লাল সতর্কতা জারি করলেও প্রশাসনের প্রস্তুতির ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। প্রশ্ন হলো, উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি? বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত হলেও স্পেনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যায় যে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারে সঠিক সমন্বয় এবং প্রস্তুতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্ধারকাজে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, প্রায় ১,৫০,০০০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং অনেকে তাদের বাড়ি ও গাড়ির ছাদে আটকা পড়েন। হেলিকপ্টার ও সেনাবাহিনীর বিশেষ দল মোতায়েন করা হলেও জনগণের অসন্তোষ থামানো যায়নি। রাজা ফিলিপ ও রানী লেটিজিয়া যখন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান, তখন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। ‘হত্যাকারী’ এবং ‘চলে যাও’ স্লোগান শোনা যায় এবং কাদা ছোড়ার ঘটনাও ঘটে। এটি প্রমাণ করে যে জনগণ প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ আগেই এলাকা ত্যাগ করলেও, রাজা ফিলিপ এবং আঞ্চলিক নেতা কার্লোস মাজন সেখানে থেকে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। এটি দেখায় যে জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে জনগণের বিপদে রাজনীতিবিদরা অনেক সময় সরে যেতে শুরু করেছেন।

বাংলাদেশ প্রায়ই ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়, আর সেখানেও প্রশাসনিক দুর্বলতা দেখা যায়। ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশের অমানবিক আচরণ, যেমন ফারাক্কা বাঁধের পানির নিয়ন্ত্রণ, বাংলাদেশের বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। স্পেনের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের প্রশাসন শিক্ষা নিতে পারে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিশ্চিত করা দরকার, যেন জনগণের জীবন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়।

গণতন্ত্রের সেরা চর্চা হিসেবে স্পেনের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। যদিও স্পেনের সাম্প্রতিক বন্যায় প্রশাসনের কিছু ব্যর্থতা দেখা গেছে, সেখানকার জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। বাংলাদেশের জন্য এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন যে, সঠিক গণতান্ত্রিক চর্চা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ও জনগণের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

জনসচেতনতা ও বৈশ্বিক বার্তা: কী ঘটল, কী দেখলাম, আর কী শিখলাম?

বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির কারণে জনসেবার বদলে শাসকগোষ্ঠী শোষণ ও স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত। স্পেন ও বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সক্রিয় প্রতিক্রিয়া বিশ্ববাসীর কাছে একটি বার্তা পাঠায়: জনগণের জাগ্রত সচেতনতা প্রশাসনের দায়িত্ববোধের প্রতি চাপ তৈরি করে এবং বিশ্বব্যাপী উদাহরণ স্থাপন করে যে নাগরিক অধিকার রক্ষা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছাত্রজনতার ঐক্য এবং স্পেনের জনগণের সাহসিকতা বিশ্বকে গভীর বার্তা দেয়—সত্যিকারের গণতন্ত্রে জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎস এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার আদায়ের ক্ষমতা রাখে। এই সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, শোষণ বা নিপীড়ন যত শক্তিশালীই হোক না কেন, জনগণের ঐক্য এবং প্রতিরোধের শক্তির কাছে তা পরাজিত হতে বাধ্য।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন ([email protected])

মন্তব্য করুন