সওজ অধিদপ্তরের নেতৃত্বে নিরাপদ সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সবচেয়ে বেশি কাজ সওজ অধিদপ্তরের। সংস্থাটি ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার মহাসড়কের নিরাপত্তার মান যাচাই করে সেগুলোর রেটিং করবে। এর মধ্যে ৫৯টি জাতীয় ও ৬৫টি আঞ্চলিক মহাসড়ক রয়েছে। এর বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে নিরাপদ করিডোর হিসেবে গড়ে তোলা হবে জাতীয় মহাসড়ক এন-৪-এর গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশের ৭০ কিলোমিটার ও এন-৬-এর নাটোর-নবাবগঞ্জের ৭০ কিলোমিটার অংশ। সড়ক দুটির প্রকৌশলগত নকশা উন্নয়ন, সাইন ও মার্কিং স্থাপন, পথচারী চলাচল সুবিধা বৃদ্ধি, গতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চালু করা হবে জরুরি সেবা। পাশাপাশি নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করবে সংস্থাটি। সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পে সওজ অধিদপ্তরের অনুকূলে সব মিলিয়ে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ( বণিক বার্তা/২৮ অক্টোবর, ২৪)
উপরে উদ্ধৃত রিপোর্টটুকু পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের নিরাপদ সড়ক নির্মাতা প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের অবস্থা কি রকম। বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের তিনটি কর্তৃপক্ষ। এই তিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে `সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি বা বড়। তারাই মূলত দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ডিজাইনার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা। তারাই এখন সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে। তবে, তাদের ওপরে আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদফতর।
গত বছরের মে মাসে শুরু হয় এই প্রকল্প। ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার মহাসড়কের নিরাপত্তার মান যাচাই করে সেগুলোর রেটিং করবে সওজ। কিন্তু সড়কগুলো ডিজাইন করা ও নির্মাণের সময় কারা দায়িত্বে ছিলো, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। সড়ক, মহাসড়ক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যদি হয় বিআরটিএ, তাহলে তাকে প্রশ্ন করবে কে? যদি হয় সড়ক ও জনপথ (সওজ), তাহলে তাকে কে প্রশ্ন করবে, যদি হয় পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদফতর, তাহলে তাকেই বা প্রশ্ন করবে কে?
সড়কগুলোর প্রকৌশলগত উন্নয়নের প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বলেই এই প্রকল্পের সড়কগুলোর নকশা উন্নয়নের চাঙ্ক রাখা হয়েছে। তার মানে সড়কের ডিজাইনের ও বাস্তবায়নে ত্রুটি রযেছে। সওজ দায়িত্ব পেয়েছে প্রকৌশলগত নকশা উন্নয়নের,, সাইন ও মার্কিং স্থাপন, পথচারি চলাচল সুবিধা বাড়ানোর, গতি নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি সেবাদানেরও। জরুরি সেবাটি যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রায় নিত্যদিনের। এতে হতাহতের পরিমাণ অঙ্গলিমেয় নয়। তাকে বড় আকারেই দেখা যেতে পারে। নিরাপদ সড়ক ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা বহু জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ করেছি, কিন্তু সেগুলোকে নিরাপদ করতে পারিনি। কেন পারিনি? সেটা কি সড়কগুলোর নির্মাণ ত্রুটির কারণে, নাকি সাইনও মার্কিং স্বল্পতার কারণে, নাকি গাড়ির চালকদের বেপরোয়া চালনার কারণে, তাদের অদক্ষতার কারণে, নাকি লাইসেন্সবিহীন ডাইভিং ও ট্রাফিকের গাফলতির জন্য, নাকি ট্রাফিকের সংখ্যাল্পতার জন্যে?
প্রশ্ন হচ্ছে যারা, মানে যে সংস্থা যাচাই করার কাজ পেয়েছে, সেই সওজের কর্মদক্ষতার মান যাচাই করবে কে? সওজ প্রকৌশলীগণ কি সত্যই উপযুক্ততায় দক্ষ? সড়ক নির্মাণের জন্য তাদের অভিজ্ঞতা কি এটাই প্রমাণ দিচ্ছে যে তাদের নির্মিত সড়কে প্রাণ যাচ্ছে না কোনো মানুষের? তাদের মান নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন দেখছি না। ঘুষে-ভাতে থাকা সওজ কর্তৃপক্ষ মহাসুখেই সরকারের সড়ক মহাসড়কের কাজ সম্পন্ন করছে। পিডব্লিউডি (পাবলিক ওয়ার্কস ডিভিশন)-এর প্রকৌশলীগণ, সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলীগণ, রাজউকের প্রকৌশলীগণসহ সরকারের যত রকম সংস্থায় কর্মরত প্রকৌশলী আছেন, তাদের আর্থিক পরিস্থিতি দেখতে যদি ওয়াচডগ রেখে তথ্য নেয়া হয়, তাহলে কিন্তু তাদের সম্পদের থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়বে। তারপরও আমরা তাদের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করতে চাই।
আবার ভুলগুলো নিয়েও কথা বলতে চাই। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা এ-সব বিষয়ে পারদর্শি নই, তবে, সড়কে দুর্ঘটনা দেখে বুকে যখন কান্নার নদী বইতে থাকে, তখন আর কারো চেহারা নয়, ভেসে ওঠে সড়ক নির্মাতাদের ভুলগুলো, যার কারণে এতো মানুষ সড়কে হত্যার শিকার হচ্ছে। সড়কের ত্রুটি যতটা না আমাদের কষ্ট দেয়, তারও চেয়ে বেশি কষ্ট দেয় পরিবহণের চালকদের অদক্ষতা ও পেরোয়া চালনা। এদের অধিকাংশই প্রশিক্ষিত, কিন্তু স্বল্প শিক্ষা ও নিরক্ষরতার কারণে মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটেনি তাদের মধ্যে। আমি এবং আমরা প্রতিনিয়তই শঙ্কায় থাকি এদের হাতে আর কত না মানুষ হত্যার শিকার হবে। যারা বেহিকলের লাইসেন্সদাতা, তারা যে টাকার বিনিময়ে অদক্ষকেও লাইসেন্স দেয়, অতীতে তার বহু নজির আছে। তারা কি একবারও এটা ভাবেন না যে ঢাকা মহানগরে কিংবা জাতীয় মহাসড়কে কি পরিমাণ গাড়ি চলাচল করলে অ্যাক্সিডেন্টের আশঙ্কা থাকবে না। সেই সাথে ড্রাইভারদের দক্ষতার ওপরই যে যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা হয়, সেটা তারা বিবেচনায় রাখেন না কেন? তারা কেবল সরকারের উপরওয়ালাদের দোহাই দেন যে তাদের চাওয়ার কারণেই অপটু চালককেও লাইসেন্স দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তারা উপরওয়ালাকে প্রত্যাখ্যান করলে তাকে বদলি করবে, এই ভয়ে অবৈধ অন্যায় ও অপরাধকর্ম করছেন। তারা যদি অবৈধ নির্দেশ না রাখেন, তাহলে তাকে কোথায় বদলি করবে? সেখানে যেতে তিনি ও তারা রাজি নন, কারণ এখানে লাইসেন্সপ্র্রদানে মাল কামানো বন্ধ হয়ে যাবে। এই ঘুষবাণিজ্য বন্ধ যাতে না হয়, সে জন্যই অবৈধ ও অনৈতিক কাজ করেন তারা। আর এতে সড়কে/মহাসড়কে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের।
এই হত্যাযজ্ঞে কতোগুলো পক্ষ জড়িত, ভেবে দেখুন একবার। এবং এদের বিরুদ্ধে কী আইন ব্যবস্থা নেবেন? আপনারাই সাজেস্ট করুন, এই সব উন্নয়ন ও অপ-উন্নয়নের ধারক ও বাহকেরা গত ৫০ বছরে এবং গত ১৬ বছরে কতো তাজাপ্রাণের হত্যাকারী এবং তাদের বাঁচাতে রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ঠুর তৎপরতা ছিলো, সদ্য বিগত স্বৈরাচারি হাসিনার আমলেও আমরা দেখেছি, এদের বিচার কি হবে না? আইন কি এতোটাই ভোতা যে সন্ত্রাসী ড্রাইভারদের, লাইসেন্সদাতাদের খুনে স্বভাবের সঙ্গে কতোটা সহমত পোষণ করে সড়কে ,মহাসড়কে অ্যাক্সিডেন্ট করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
আমি সব সময়ই পলিটেকনিক শিক্ষার পক্ষে। কারণ, বিদেশে আমাদের দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা আছে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে দেশেও পলিটেকনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনবল প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমাদের চাহিদা কতোটা, কোন কোন খাতে? সেই সব খাতের চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বিদেশে কতোটা চাহিদা রয়েছে এবং সেগুলো কোন কোন খাতের, সেটা মনে রেখে পলিটেকনিক বা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।সড়কের, মহাসড়কের ডিজাইনারগণ কী এর সঙ্গে জড়িত নয়? সড়ক নির্মাতা ও সড়কে নিরাপত্তময় কোনো ব্যবস্থা না রেখে যারা এ সব অনুমোদন করেছেন, তারা কি দায়ী নন? প্রত্যেকটি মহাসড়কে গাড়ির বিশ্রামের জন্য আলাদা স্পেস রাখতে হয়। তারপাশে রাখতে হয় সার্ভিস রাস্তা বা ছোটো সড়ক? আমাদের হাইওয়েগুলোতে কী সে ব্যবস্থা আছে? ড্রাইভারদের বিশ্রাম ও লাঞ্চের জন্য কি বিশ্রামাগার ও রেস্তোরাঁ আছে? আমাদের ভাবতে হবে এ-সব নিয়ে। আমাদের হাইওয়েগুলো সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হাইওয়ে হয়ে উঠুক, এটাই তো আমাদের চাওয়া।
দুই.
দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয় ৯৮ হাজার ৪৬ শিক্ষার্থী। সে অনুযায়ী ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ আসনই ফাঁকা রয়ে যায়। কোনো কোনো কোর্সে আবার ফাঁকা আসনের হার ৯০ শতাংশ। বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেশির ভাগই চাকরি না পাওয়ায় বছর বছর শিক্ষার্থী কমছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতেও আরো ২৩ জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
জনসংখ্যাকে দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদে রূপান্তর ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্প্রসারণকে লক্ষ্য রেখে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। যদিও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম না থাকা, শিক্ষক সংকটসহ নানা সংকট সমাধান না করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুধুই দৃশ্যমান উন্নয়ন। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির যে লক্ষ্য তা থেকে দূরে সরে গিয়ে বেকার তৈরির নতুন আয়োজন কেবল। ( বণিক বার্তা/২৮ অক্টোবর, ২৪)
মন্তব্য করুন