বাংলাদেশের উন্নয়নশীল সমাজে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং প্রশাসনিক সুশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশে প্রশাসনিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন এবং সংস্কারের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, যা বিশেষত দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জনসেবামূলক দায়িত্ব পালনে প্রশাসনের অক্ষমতার কারণে এসেছে। বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিকদের মতে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে নীতি ও নৈতিকতার মান উন্নত করা জরুরি। জনগণের কল্যাণে প্রশাসনকে আরও মানবিক এবং জবাবদিহিমূলক করতে এই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত প্রকট।
প্রশাসনিক দুর্নীতি: চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতা
বাংলাদেশে প্রশাসনের দুর্নীতি একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মকর্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে পদোন্নতি কিংবা পোস্টিং বেছে নেন এবং কৌশলে বিদেশে পদায়ন বা বিশেষ সুবিধাপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং নিতে চান। এই ধারা এতটাই প্রকট হয়েছে যে, অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিদেশে পদায়নের সুযোগ হারানোর ভয়ে পদোন্নতি নিতে চান না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কিছু সরকারি দপ্তরের কর্মীদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসে পোস্টিংয়ের সুযোগ থাকে, কিন্তু পদোন্নতি গ্রহণ করলে সেই সুযোগটি হারাতে হয়। ফলে, তাদের একটি বড় অংশ পদোন্নতি এড়িয়ে যাবার পথ বেছে নিচ্ছেন।
কেবল প্রশাসনিক কর্মকর্তা নয়, একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে শিক্ষক, ডাক্তারসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যেও। যেখানে দুর্নীতির সুযোগ কম বা যেখানে অধিক পরিশ্রম করতে হয়, সেখানে কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করা একটি সাধারণ চিত্র। গ্রামের সেবা দানে অনীহা এবং শহরকেন্দ্রিক সুবিধা গ্রহণের প্রবণতা জাতীয় উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে বসবাস করে এবং তারা সঠিকভাবে সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকার রাখে। এভাবে যদি রাষ্ট্রের যন্ত্র নিজের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে, তবে এটি দেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে পরিণত হবে।
দুর্নীতি কমাতে এবং সেবা নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন
প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হলে আমাদের দেশের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন না হলে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি এবং অপব্যবহার কমানো সম্ভব নয়। যারা বিদেশে পদায়ন কিংবা সুবিধাজনক পোস্টিং পেতে চান, তাদের এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে প্রশাসনে একটি জবাবদিহিমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট নিয়ম এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে এই ধরনের চর্চা কমানো সম্ভব।
কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
যেসব প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তা দেশের বাইরে কাজ করার সুযোগ চান বা পদোন্নতির মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে চান, তাদের পেশাগত নৈতিকতা এবং জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। একজন সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব দেশের সেবা করা, শুধুমাত্র নিজের সুবিধা নিশ্চিত করা নয়। প্রশাসনের এই ধরনের অসদাচরণ সরকারের মৌলিক কাঠামো এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসকে নষ্ট করছে। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে থেকে শুরু করে সাধারণ স্তরের কর্মচারী পর্যন্ত সবাই যদি তাদের দায়িত্ব পালনে আরও সঠিক এবং আন্তরিক হন, তবে জনসেবা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার অপরিহার্য। অনলাইন পোর্টাল, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এবং সরাসরি তথ্যপ্রদান পদ্ধতি চালু করে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে জনগণের সামনে উন্মুক্ত করা গেলে দুর্নীতি এবং অপব্যবহার কমবে। নাগরিকরা সরাসরি প্রশাসনের কাছে তাদের অভিযোগ, পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় সেবার জন্য আবেদন করতে পারবে, যা সরকারের জবাবদিহিতা বাড়াবে। উদাহরণস্বরূপ, অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছানো, অভিযোগ গ্রহণ এবং কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন একটি স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
গ্রামীণ এলাকায় জনসেবার উন্নয়ন
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ গ্রামে বসবাস করে, যেখানে সাধারণত সরকারি সেবার পরিধি তুলনামূলকভাবে কম। গ্রামগুলোতে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার সুযোগ এবং অন্যান্য মৌলিক সেবার অভাব রয়েছে। এই সেবাগুলির উন্নয়নে প্রশাসনিক কর্মচারীদের গ্রামীণ এলাকায় কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সরকারি কর্মচারীরা গ্রামাঞ্চলে কাজ করার জন্য আরও উৎসাহী হন। পাশাপাশি, গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে, যাতে তারা উৎসাহিত হন এবং সেখানে দায়িত্ব পালনে আরও মনোযোগী হন।
জনপ্রশাসনে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার উন্নয়ন
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রশাসনে নৈতিকতা এবং জবাবদিহিতার মান বৃদ্ধি অপরিহার্য। সরকারি কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং যদি কেউ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা বাড়াতে জনমত এবং নাগরিকদের মতামত সংগ্রহ করে তার ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: আদর্শ প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের পথে
বাংলাদেশে আদর্শ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথে চলা এখন সময়ের দাবি। প্রশাসনের নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকাগুলোর মধ্যে সেবার বৈষম্য কমানো সম্ভব। প্রশাসনিক সংস্কারের এই ধারাবাহিক প্রয়োগের ফলে দেশের নাগরিকরা তাদের প্রাপ্য সেবা দ্রুত এবং স্বচ্ছভাবে পেতে সক্ষম হবে।
সুশাসনের মাধ্যমে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানই নয়, বরং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এমনকি সুশাসনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, যা দেশের জন্য একটি বড় অর্জন হিসেবে গণ্য হবে।
পরিশেষে: বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি
একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা আমাদের সকলের জন্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে যদি সঠিক নিয়ম, স্বচ্ছতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার নীতিমালা চালু করা যায়, তবে এই দেশে দুর্নীতি কমে আসবে এবং উন্নয়নের পথে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রয়োজন একটি কার্যকর এবং জনকল্যাণমুখী প্রশাসন, যেখানে জনগণের সেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এটাই হোক আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য—একটি উন্নত, সুশাসিত এবং মানবিক বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ এবং সেবার অধিকার ভোগ করবে।
এই সকল উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ একটি সুদৃঢ় রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যা হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্থায়ী ভিত্তি এবং দেশের জন্য এক চিরস্থায়ী সম্পদ।
যোগাযোগের জন্য:
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
([email protected])
মন্তব্য করুন