বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গণঅভ্যুত্থানে সরকার অপসারণ ও পদত্যাগপত্রের গুরুত্বহীনতা

শেখ ওমর
  ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৩৭
ছবি-সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থান হলো জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও শক্তির বহিঃপ্রকাশ— যার ফলে কোনো দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা/শাসন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। সাধারণত, এমন পরিস্থিতিতে সরকার পতনের প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক নিয়ম বা পদত্যাগপত্রের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে না। ক্ষমতা চলে আসে জনগণের ইচ্ছা/অভিপ্রায়ের অধীনে, আর জনগণের সেই সম্মিলিত অভিপ্রায় বা ইচ্ছাই তখন নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এই বাস্তবতা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের অনেক দেশে দেখা গেছে।

১৯৭৯ সালের ইরানের উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। যখন প্রবল গণআন্দোলনের চাপে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি সরকারের পতন ঘটে, তখন তিনি কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করেননি। ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ তারিখে তিনি সপরিবারে বিমানে চড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং তার অনুপস্থিতিতেই ইরানে একটি নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে ইরানের জনগণের ইচ্ছাই নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন হয়ে পড়ে একেবারেই গৌণ।

এ ধরনের ঘটনার পেছনে মূলত আন্তর্জাতিক আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি কাজ করে: জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছাই হলো যে কোনো রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসনব্যবস্থার বৈধতার ভিত্তি। একটি শাসনব্যবস্থা বা সরকার তখনই বৈধতা পায়, যখন তা জনগণের সমর্থন লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে স্বীকৃতি দেয়। সাংবিধানিক বা আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সরকারও যদি জনগণের ইচ্ছার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, সেই সরকার তার ক্ষমতায় থাকার বৈধতা হারায় এবং তার পতন ঘটে।

রোমানিয়ার স্বৈরশাসক নিকোলাই চশেস্কুর উদাহরণটিও বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাদৃশ্যপূর্ণ। নিকোলাই চশেস্কু ছিলেন রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এবং তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। চশেস্কুর শাসনকাল ছিল কঠোর দমনমূলক, জনগণের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার ও অর্থনৈতিক সংকটের সময়। ১৯৮০-এর দশকে তার পরিচালিত অর্থনৈতিক নীতি দেশকে একটি বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। জনগণের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হতে থাকে এবং সেই সময়ে রোমানিয়ায় ব্যাপক অভাব দেখা দেয়।

১৯৮৯ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপের অন্য কমিউনিস্ট শাসনগুলো একের পর এক পতনের সম্মুখীন হচ্ছিল। এই পটভূমিতে রোমানিয়ার জনগণও চশেস্কুর শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। ডিসেম্বরের শুরুতে রোমানিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর টিমিসোয়ারাতে একটি বিদ্রোহ শুরু হয়, যা দ্রুত অন্য শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে এই বিক্ষোভ চশেস্কুর অনুগত সেনাবাহিনী দমন করার চেষ্টা করে, কিন্তু জনগণের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

প্রবল বিক্ষোভের মুখে ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৯ তারিখে চশেস্কু সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সেনাবাহিনীও তখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। মরিয়া অবস্থায় চশেস্কু কেন্দ্রীয় কমিটির ভবনের সামনে জড়ো হওয়া জনতাকে শেষবারের মতো একটি ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু সমবেত জনতা তার দিকে পাথর ছুড়তে শুরু করে। তিনি ভাষণের আশা ত্যাগ করে ভবনের ভিতরে আশ্রয় নেন এবং জনগণের ধাওয়ার মুখে কোনো মতে ভবনের ছাদ থেকে একটি হেলিকপ্টারে স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানী ছেড়ে অন্য শহরে পালিয়ে যান।

জনতার ইচ্ছা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, চশেস্কুর কোনো রকমের আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের প্রয়োজন হয়নি এবং রোমানিয়ার কেউ তার পদত্যাগপত্রও খোঁজেনি। একইভাবে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ তীব্র গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং কোনো আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র ছাড়াই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ইউক্রেনেও কেউ ইয়ানুকোভিচের পদত্যাগপত্রের সন্ধানে নামেননি।

২০১১ সালে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক আরব বসন্তের বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হন। হোসনি মুবারকের সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে হোসনি মুবারকের পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। হোসনি মুবারকও আসলে কোনো আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেননি এবং কেউ সেটার অপেক্ষায়ও থাকেনি।

বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হননি, তিনি পালিয়েও গিয়েছেন এবং ভারতের আশ্রয়েও আত্মগোপনেই আছেন। শেখ হাসিনারই নিয়োগকৃত ও অনুগত বিচারপতিদের সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ভারতসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও রাষ্ট্র বাংলাদেশের এই অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আড়াই মাস পরে এসে ক্ষমতাচ্যুত শাসকের পদত্যাগপত্র খোঁজা কেবলই অতি উৎসাহী সাংবাদিকতা নয়, এটা অপরিণামদর্শী ও চক্রান্তমূলক পদক্ষেপ।

অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মন্তব্য করুন