লিনসোপিং আমার জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই শহর ছিল আমার পড়াশোনার কেন্দ্র। সরাসরি বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে পা রাখা এবং নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। লিনসোপিং শুধু একটি শহর নয় বরং আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ও শিক্ষার স্থান।
এখানে আমার বাবা-মা বহুবার এসেছেন, আর বড় ভাইয়ের পিএইচডি এবং শিক্ষকতার জীবনও এখান থেকেই শুরু হয়। এই শহর যেন আমাদের পরিবারের একটি মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই শহরে ফেরার প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে শিক্ষা, পরিবার এবং জীবনের নতুন অধ্যায় একসাথে মিশে গিয়েছিল।
সুইডেনে আসার পর খুব একটা বাংলাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, যার ফলে বাবা-মাই প্রতি বছর সুইডিশ সামারে এখানে বেড়াতে আসতেন। তখন বিশ্বের যেখানেই থাকি না কেন সুইডেনে এলেই বাবা-মাকে দেখতে লিনসোপিং-এ প্রায়ই আসা হতো। স্টকহোম থেকে রওনা দিতেই ফোনের পর ফোন আসতো আর কতক্ষণ লাগবে আসতে? সব সময় বলতেন তাদের বাসায় ঢোকার আধাঘণ্টা আগে যেন ফোন করি।
কারণটা কোনো একদিন জিঙ্গেস করেছিলাম, বাবা উত্তরে বলেছিলেন ঠিক তখন তোমার মা হাড়িতে ভাত বসান যেন খাবার ঠান্ডা না হয়। কতবার বলেছি এখানে তো খাবার গরম করা কোনো ব্যাপার না? তারপরও সেই একই কাহিনি বার বার ঘটেছে। বাবা-মা বেঁচে নেই আছে শুধু স্মৃতি। আমার বিদেশ জীবন সত্যিই এক আশির্বাদ কারণ প্রতি বছরই বাবা-মার সঙ্গে দেখা হতো। তারপর হঠাৎ ঘটে গেলো এক দুর্ঘটনা।
২০০৪ সালে আমার মা নামাজ পড়া অবস্থায় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়েন। আমার বাবা বুঝতে পারেননি সমস্যাটি, মাকে বিছানায় শুইয়ে দেন। রাত ১২টার দিকে মার কথায় কিছুটা জড়তা অনুভব করেন। পরে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলে। হাসপাতালে যাবার পর পরই চিকিৎসক বলেন মার স্ট্রোক করেছেন।
আমি সুইডেনের অন্য আরেকটি শহরে, যার ফলে মার কাছে যথা সময়ে আসতে পারিনি সেদিন। যে ট্রেনে রওনা দিয়েছি ঠিক সেই ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে একটি লোক আত্মহত্যা করে মারা যায়। পুলিশ তদন্ত এবং নানা জটিলতার কারণে আমার আসতে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়। যখন হাসপাতালে এসে হাজির হলাম দেখি মার পুরো ডান সাইডটা অচল, কথা বলতেও পারছেন না। একটু তরল জাতীয় খাবার চামুচ দিয়ে মার মুখে দিতেই মা এমন করে হাঁছি দিলেন যেসব খাবার আমার শরীরে এসে পড়লো।
একটু হেসে মাকে বললাম, ছোট বেলায় নিশ্চয় এমনটি আমি করেছি তোমাকে তাই না মা? মা সেদিন হেসেছিলেন। মার হাসি দেখে মনে হয়েছিল ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।
২০০৬ সালে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে আমার মা সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পরে মার জানাজা কাজ এবং কবর সম্পন্ন করা হয়। তারপর থেকে নিয়মিত আশা যাওয়া লিনসোপিং-এ। আজও মার কবর জিয়ারত করতে এলেছিলাম।
আমার সাথে এসেছেন আমার স্ত্রী মারিয়া এবং তার বাবা। মায়ের কবর জিয়ারতের পর আমরা কিছুটা সময় ভ্রমণেও কাটাব ভাবছি।
ঠান্ডা শরতের দিনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আজ এবং আগামীকাল গাড়িতে করে যে সমস্ত জায়গাগুলো ঘুরব তার মধ্যে রয়েছে ভাডস্টেনা, ইয়োতা খাল এবং লিনসোপিং। অনেকে জানতে চেয়েছে এসব শহরগুলোতে কী দেখার আছে এবং কেনই বা বিক্ষাত ইত্যাদি। আমি নিম্নে একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণমুখর প্রতিবেদন পেশ করছি।
১. ভাডস্টেনা (Vadstena)
ভাডস্টেনা সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলে, ভ্যাটার্ন হ্রদের ( Vättern sjö) তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর। এটি লিনসোপিং থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে। ভাডস্টেনা তার মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য এবং ভাডস্টেনা অ্যাবির জন্য বিখ্যাত। এটি সেন্ট ব্রিগিটার প্রতিষ্ঠিত একটি মঠ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। শহরের ভাডস্টেনা ক্যাসেলও দেখার মতো একটি স্থান, যা সুইডেনের রেনেসাঁস স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন।
ভাডস্টেনা অ্যাবি: ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক জায়গাটি ঘুরে দেখতে পারেন।
ভাডস্টেনা ক্যাসেল: এর অভ্যন্তরীন স্থাপত্য আপনাকে রেনেসাঁসের সেরা কীর্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
হ্রদ তীরে হাঁটা: ভ্যাটার্ন হ্রদের তীরে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে।
২. ইয়োতা খাল (Göta kanal)
ইয়োতা খাল পূর্ব উপকূলের সডোরশোপিং (Söderköping) থেকে পশ্চিম উপকূলের গথেনবার্গ (Göteborg) পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি ওস্টেরইয়োতল্যান্ড (Östergötland) অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
১৯ শতকে নির্মিত এই খালটি সুইডেনের অন্যতম বৃহৎ প্রকৌশল কীর্তি। এটি প্রায় ১৯০ কিমি দীর্ঘ এবং পর্যটকদের জন্য নৌভ্রমণের একটি জনপ্রিয় পথ।
নৌযাত্রা: ইয়োতা খাল ধরে নৌভ্রমণ করা একটি মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা।
সাইক্লিং: খালের তীর ধরে সাইকেল চালিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
লক সিস্টেম: খালের লকগুলো দেখতে পারেন, যা প্রকৌশল দক্ষতার উদাহরণ।
৩. লিনসোপিং (Linköping)
লিনসোপিং সুইডেনের পূর্বাংশে ওস্টেরইয়োতল্যান্ড অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর। লিনসোপিং-এর বিক্ষাত হাজার বছরের পুরনো ক্যাথেড্রাল, পুরাতন লিনসোপিং (Gamla Linköping) এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পরিচিত। এখানে অবস্থিত লিনসোপিং ইউনিভার্সিটি যা সুইডেনের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
লিনসোপিং ক্যাথেড্রাল: প্রাচীন গথিক স্থাপত্য এবং ধর্মীয় শিল্পকর্ম উপভোগ করতে পারেন।
গামলা লিনসোপিং: পুরানো শহরটি ঘুরে দেখার মতো একটি আকর্ষণীয় জায়গা, যেখানে সুইডেনের পুরাতন স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যিক জীবনধারা অনুভব করতে পারবেন।
এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম: সুইডেনের বিমান শিল্পের ইতিহাস জানতে এই মিউজিয়ামটি দেখার মতো।
স্টকহোম থেকে দূরত্ব এবং যোগাযোগ
ভাডস্টেনা: স্টকহোম থেকে প্রায় ২৬০ কিমি, গাড়িতে যেতে ৩-৪ ঘণ্টা লাগে।
ইয়োতা খাল: ইয়োতা খালের কাছাকাছি অংশ স্টকহোম থেকে ২-৩ ঘণ্টা দূরে।
লিনসোপিং: স্টকহোম থেকে প্রায় ২৪০ কিমি এবং ট্রেনে বা গাড়িতে যেতে ২-২.৫ ঘণ্টা লাগে।
আমার এই ভ্রমণ শুধু ইতিহাস ও প্রকৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য ছিল না, বরং নিজের অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া। ভাডস্টেনা, ইয়োতা খাল, এবং লিনসোপিং—এই তিনটি জায়গা আমাকে শুধু সুইডেনের নয় বরং আমার জীবনের নানা অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ভ্রমণ যেন আমাকে আবার সেই সময়ের মায়ার জগতে ফিরিয়ে নিয়েছে, যেখানে মায়ের কবর, পরিবার, শিক্ষা, এবং ভালোবাসা একসাথে মিশে ছিল।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
মন্তব্য করুন