ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত দুই মাস ধরে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে দেশ এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সুশাসন, দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি আশাব্যঞ্জক ভাষণ দেন, যেখানে তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এই ভাষণ শুধু দেশের জনগণকেই নয়, বিশ্বকেও অনুপ্রাণিত করেছে, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
দুই মাসের সংস্কার এবং পরিবর্তন:
গত দুই মাসে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:
১। দুর্নীতি দমন: তার সরকার দুর্নীতি দমনে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা আনতে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর ফলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে আস্থার জন্ম দিচ্ছে। এখন জনগণ দেখতে পাচ্ছে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
২। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কার: একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ড. ইউনূস স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘নির্বাচন হতে হবে এমন, যেন জনগণ তাদের মতামত নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে এবং ভোটের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।’ এরই ধারাবাহিকতায়, নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু নতুন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
৩। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার ব্যবস্থাকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে তিনি বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। তার সরকার বিশ্বাস করে, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগই সুশাসনের মূল ভিত্তি। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত করার এ উদ্যোগ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
৪। সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন: ড. ইউনূস তার মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে আরও সম্প্রসারিত করে দেশের নিম্নবিত্ত জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে কাজ করছেন। তার লক্ষ্য হলো দারিদ্র্যের শিকড়গুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। সরকারের বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে বদ্ধপরিকর।
রাজনৈতিক সমঝোতা এবং চ্যালেঞ্জ:
ড. ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশকে একত্রিত করার জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করছেন এবং জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে কাজ করছেন। যদিও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করছে, ধীরে ধীরে তার নিরপেক্ষতা ও সততার প্রতি সবার আস্থা বাড়ছে। তার মূল লক্ষ্য একটি স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গঠন করা, যেখানে মতপার্থক্য সত্ত্বেও সবাই মিলে দেশের উন্নয়নে কাজ করবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া:
ড. ইউনূসের সংস্কারমূলক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মহলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তার নেতৃত্বের প্রশংসা করছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ড. ইউনূসের নৈতিকতা, সততা এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে নতুন করে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও গতিশীল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
করণীয় এবং বর্জনীয়:
করণীয়:
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: জনগণকে সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন রাখতে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করতে মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
নাগরিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ: দেশের উন্নয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের সচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ড. ইউনূস নিজেও জনগণকে অনুরোধ করেছেন, ‘আমাদের দেশকে গড়তে হলে একত্রে কাজ করতে হবে।’
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও দক্ষ ও সচেতন করা সম্ভব। এই দুই খাতের উন্নয়নই একটি সমৃদ্ধ সমাজের মূল ভিত্তি।
বর্জনীয়:
অতি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা: দেশের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যেন তা বাস্তবায়নযোগ্য হয় এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করে।
রাজনৈতিক পক্ষপাত: কোনও নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জনগণ তাদের নেতৃত্বে নিরপেক্ষতা ও সৎ প্রশাসন প্রত্যাশা করে।
দ্রুত সমাধানের প্রলোভন: সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। দ্রুত সমাধানের প্রলোভন দিয়ে বড় সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না।
শেষ কথা:
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ড. ইউনূসের মতো একজন নীতিবান, সৎ এবং আন্তরিক নেতা এখন দেশের হাল ধরেছেন। আমাদের সকলের উচিত তার হাতকে শক্তিশালী করা, যেন দেশ আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এ মুহূর্তে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে তাকে এবং তার সরকারকে সর্বোচ্চ সাহায্য করা জরুরি।
তাই, আমার বিনীত অনুরোধ, আসুন আমরা সকলে মিলে ড. ইউনূস এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে শতভাগ সমর্থন ও সহায়তা করি। দেশ গড়ার এই মহাযজ্ঞে আমরা যদি সকলে অংশ নিই, তাহলে একটি সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
মন্তব্য করুন