শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখা হোক

রহমান মৃধা|
  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:০১ | GMT +6

শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ও দেশ পুনর্গঠনে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে একটি রোডম্যাপ প্রস্তাব করছি। এই রোডম্যাপের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেওয়া।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, ভণ্ডামি এবং প্রতিহিংসার এক দুষ্টচক্র চলছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে, যার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফাটল দেখা দিয়েছে এবং প্রশাসনিক শুদ্ধাচার ও জবাবদিহিতা ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে। যদি এ সমস্যা সমাধান না করা হয়, তবে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে এবং ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

সমস্যার মূল কারণ
১। দুর্নীতির বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার:

প্রশাসনিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্নীতি একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে, যার ফলে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি যেন এখন নীতি হিসেবে পরিণত হয়েছে। তোষামোদি, তেল মারা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে, যা প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আরও বিপজ্জনক রূপ ধারণ করবে।

২। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা:

প্রশাসন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাদের স্বাধীনতা হারাচ্ছে। এর ফলে, তারা জনগণের সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং এই দুর্বলতা আরও প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের কর্তব্য পালনে অবহেলা করছেন। পাশাপাশি, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন এবং এর ফলে প্রশাসনের কর্মক্ষমতা দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সিন্ডিকেট কাজ করছে, যা প্রশাসনিক শুদ্ধাচার ও ন্যায়বিচারের পথে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

৩। বিচারহীনতা ও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি:

ক্ষমতা পরিবর্তনের পর প্রতিশোধমূলক রাজনীতি একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নতুন সরকার পুরনো সরকারের অপরাধ তুলে ধরে সমালোচনা করে। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত না করে তা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং এ ধারা চলতে থাকলে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। যুগ যুগ ধরে বিচারহীনতার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা হঠাৎ নতুন সরকারের অধীনে বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে, যা দেশে ও বহির্বিশ্বে বিচারব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। চলমান পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে ন্যায়নীতি এবং সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা বিলীন হয়ে যাবে। অন্যদিকে, উচ্চপদস্থদের চাকরির সময় কেন এসব দুর্নীতি ধরা পড়ে না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। নিশ্চয়ই, এর পেছনে বড় ধরনের সিন্ডিকেট কাজ করছে যা সাধারণ জনগণের কাছে প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

প্রতিরোধের উপায়
১. প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা:

প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসন এবং সিভিল প্রশাসনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখতে হবে। এর জন্য আইনি ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকবে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করবে।

২। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ:

দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখে নয় বরং তাদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে। প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এর ফলে ভবিষ্যতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সহজ হবে। দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি শক্তিশালী নৈতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৩। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা সংরক্ষণ ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা:

প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে এবং তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসনই পারে প্রকৃত জনসেবায় অবদান রাখতে।

৪। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ:

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলা আবশ্যক। প্রশাসনের কার্যক্রম সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে, যেন জনগণ প্রশাসনের কাজের প্রতি সজাগ থাকে এবং ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হয়। গণমাধ্যমকে গুজব বা প্রোপাগান্ডার স্থান না দিয়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণ যেন জনগণের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৫। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার:

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, যেন ভবিষ্যতে তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি মামলাগুলো ঝুলিয়ে রাখার পরিবর্তে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেন ও অন্যায় পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশে কার্যকর ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনিক শুদ্ধাচার, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রকৃত জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তাবিত এই রোডম্যাপ তাদের ভূমিকা ও অবদানকে স্পষ্ট করবে, এবং গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ও দেশের পুনর্গঠনে তাদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে, রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে জনগণের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখতে হবে।

রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

মন্তব্য করুন