শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

২০১৮ সালের খোলা চিঠির প্রাসঙ্গিকতা: ২০২৪ সালের প্রতিফলন

রহমান মৃধা|
  ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:১৮ | GMT +6

আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম ২০১৮ সালে। লেখাটি পাবলিশ করার জন্য অনেক গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, কিন্তু ভয়ে কেউ প্রকাশ করতে সাহস করেনি। শেষমেশ ফেসবুক এবং অনলাইন পোর্টাল ‘দৈনিক বার্তা’ সাহসিকতার সাথে লেখাটি প্রকাশ করে ২ জুন, ২০১৮-তে, তখন কেউ আমার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি। বহু চেষ্টা করেছিলাম শেখ হাসিনার কাছে বার্তাটি পৌঁছাতে, কিন্তু জানি না তিনি চিঠিখানা পড়েছিলেন কি না। 

তাকে যে কাজটি করতে অনুরোধ করেছিলাম আজ এত বছর পর, ঠিক সেই কাজটি করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তবে বড্ড দেরিতে। কত মানুষের জীবন গেলো, কত বড় ক্ষতি হলো, কত মানুষ অমানুষ হলো—এটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তবুও বলব জাতিকে, ‌‘‘Never too late to change your mind.’’ আমি শিক্ষার্থীদের এখন শুধু বলতে চাই, তোমরা থেমে যেও না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত না হয়, ততদিন চালিয়ে যাও তোমাদের মিশন। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি সেদিন কী লিখেছিলাম? লেখাটি তোমাদের অবগতির জন্য দিয়ে রাখলাম।

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, খোলা চিঠি দিলাম আপনার কাছে। গণতন্ত্র মানে বাক স্বাধীনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস এবং সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা। মতের ভিন্নতা এবং খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে যখন ঐক্য হয়, তখনই জাতি স্বাধীনতার সুফল পায়। কিন্তু যখন পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনীতিবিদ বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়, তখন গণতন্ত্র জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যক্তি ও সুসম্পর্ক নষ্ট হয়, এবং ধীরে ধীরে গণতন্ত্র বিলীন হয়ে যায়। তখন দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়।

স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পরেও আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের সর্বোত্তম চর্চা হয়নি। আজ কিছু সত্যকে আলোকিত করতে চাই দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য। উন্নয়নশীল জাতির বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীকে সঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে ব্যারাকে রাখা হয়েছে, যেন তারা ‘স্লিপিং টাইগার’। বছরের পর বছর তারা তাদের চাকরির মেয়াদ পার করছেন, মাঝে মাঝে সরকারের কিছু কাজে সাহায্য করা, নিজেদের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিদেশি মিশনে যাওয়াই তাদের কাজ। 

তারা বছরে কয়েকবার, যেমন বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে, জনগণকে আশ্বস্ত করতে দেখা দেন যে তারা আছেন।
যদি তাদের কমিটমেন্ট এমন হয়, তবে আমার প্রশ্ন কেন তাদের দেশের অন্যান্য এলাকায় কাজে লাগানো হচ্ছে না? কেন তাদের ঢাকার মধ্যে বা দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রেখে সোনার বাংলা গড়ার কাজে লাগানো হচ্ছে না?

রাজনীতির বর্তমান অবস্থা আরও জটিল। বাবা-মা বা দাদা মন্ত্রী ছিলেন, আর এখন বংশের চৌদ্দ গোষ্ঠী সেই সুবিধা ভোগ করছেন। তারা ভুলে গেছেন বাংলাদেশে ১৭ কোটি লোকের বাস এবং তাদেরও একটি অধিকার রয়েছে তাদের জন্মভূমির ওপর। এটি কি গণতন্ত্র? নাকি রাজতন্ত্র, ভণ্ডামিতন্ত্র, বা ভোগতন্ত্র? যদি বর্তমান যারা জেনারেল, সচিব বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন, তাদের ছেলে-মেয়ে পরে সেই পদ দখল করে জন্মসূত্রে, তবে দেশের অবস্থা কী হবে?

প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। সৎ ও ভালো মানুষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে, আপনার বাবার সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করুন। আপনি দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারবেন—এই বিশ্বাস রাখি। গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা করতে, দেশের সবাইকে একত্রে কাজে লাগিয়ে, সুশিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাগজের টাকা মুক্ত সোনার বাংলা গড়াই হোক জাতির পিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

‘এখনও কিছু লোক আছেন, যারা সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাদের নেতৃত্বে দেশকে সুশিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।’

২০১৮ সালের জুন মাসে, আমি বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ওপরের খোলা চিঠি লিখেছিলাম, যা আমার মধ্যে জমে থাকা অনেক প্রশ্ন এবং উদ্বেগের প্রতিফলন ছিল। সেই সময়ে, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা ছিল, যা আজও বিদ্যমান। তবে, বর্তমানে ২০২৪ সালে এসে দেখি যে, সেই সময়ের কিছু সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে, কিন্তু অনেকগুলো সমস্যা রয়ে গেছে বা নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে।

এই প্রতিবেদনটিতে, আমি ২০১৮ সালে লেখা আমার চিঠির বিষয়বস্তু পুনঃপর্যালোচনা করবো এবং বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করবো।

২০১৮ সালে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক দুর্নীতি, ঘুস এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছিল। আমি সেই সময়ে বিশ্বাস করতাম, দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে কেবল ব্যারাকে আটকে না রেখে, দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধানে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা উচিত। আমার চিঠিতে আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলাম:

‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে ঢাকার ভেতরে বা দেশের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে (যেখানে কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল গড়ে উঠার কথা) রাখা হয়েছে? তাদের কেন দেশের অন্যান্য এলাকাতে রাখা হয়নি? কিন্তু যদি সত্যিকারে তাদের সোনার বাংলা গড়ার এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর থেকে দেশকে মুক্ত রাখার জন্য বেতন দেওয়া হয় দেশের মেহনতি মানুষের উপার্জিত অর্থ থেকে তবে তাদের অবশ্যই সক্রিয় ভাবে কাজে লাগাতে হবে।’

এখন, ২০২৪ সালে এসে দেখছি, বাংলাদেশের কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু অনেক সমস্যাই এখনও রয়ে গেছে। সশস্ত্র বাহিনী কিছু ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা এখনো দেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির জাল এখনও দেশের প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত।

আমার ২০১৮ সালের চিঠিতে উল্লিখিত গণতন্ত্রের চর্চার অভাব এবং সুশাসনের ঘাটতি ২০২৪ সালেও তেমন পরিবর্তিত হয়নি। আজও দেশের সাধারণ মানুষ তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল হচ্ছে, যা আমি ২০১৮ সালেও লক্ষ্য করেছিলাম।

২০১৮ সালে আমি যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম, তার অনেকটাই ২০২৪ সালে এসে এখনো সত্য। যদিও কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তবে সেগুলো যথেষ্ট নয়। দেশের সঠিক উন্নয়ন এবং সোনার বাংলা গঠনের জন্য, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক সমস্ত স্তরের আরও অনেক বেশি সুশাসন এবং সততার প্রয়োজন। দেশের নেতৃত্বের উচিত নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে জাতির স্বার্থে কাজ করা, এবং সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল প্রতিষ্ঠানের উচিত সক্রিয়ভাবে দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা।

২০২৪ সালে এসে আমি সেই একই বার্তা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই যা ২০১৮ সালে বলেছিলাম: ‘Never too late to change your mind.” দেশের ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে সঠিক পথে কাজ করতে হবে, এবং গণতন্ত্রের সত্যিকারের চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমাদের সবার একসাথে কাজ করার মাধ্যমে, সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।

পরম করুণাময় আল্লাহ তাওয়ালা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সুশোভিত করেছেন। এর মধ্যে অনেক কিছু আকারে বড়, আবার অনেক কিছু আকারে ছোট। কিছু জিনিস মূল্যবান, আবার কিছু জিনিস তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। মানুষ সাধারণত বড় বা মূল্যবান জিনিসের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে এবং ছোট ও নগণ্য জিনিসকে তুচ্ছ মনে করে অবহেলা করে। কিন্তু এই অবহেলা ঠিক নয়, কারণ অনেক ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বস্তুর মাঝেও মূল্যবান কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। বাইরের অবয়ব বা আকৃতি দেখে কোনো জিনিসের সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। বাহ্যিকভাবে কেউ কুৎসিত বা কদাকার হলেও সে সুন্দর মন বা হৃদয়ের অধিকারী হতে পারে। সব ঝলমলে পাথর মূল্যবান নয়। মাকাল ফলের বাইরের অংশ যতটা সুন্দর, ভেতরের অংশ ততটাই অসুন্দর। 

সুতরাং, সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে, অনেক তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের মাঝেও মহামূল্যবান রত্নের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাইতো কথায় বলে -যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

মন্তব্য করুন