শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

প্রজন্মের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ

নাজনীন বেগম
  ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৮:১৭
ছবি- সংগৃহীত

উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাওয়ার মৌলিক কার্যক্রমই শিক্ষা ব্যবস্থাপনা। শিক্ষা জাতির মেরুদ-। যার অভাবে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানো এক মহাবিপত্তির বিষয়। তাই সম্প্রতি বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস নাশকতার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থী সমাজ অনেকটাই তাদের নিয়মিত পাঠক্রম থেকে চ্যুত, বিচ্ছিন্ন।

এমনটি পুরো জাতির জন্য কোনো শুভ সংকেত তো নয়ই। এমনিতেই প্রাতিষ্ঠানিক বলয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা চিহ্নিত।

সেখানে নানা মাত্রিক অনাসৃষ্টিতে তা যে কতখানি বিস্তৃত হয় সেটা সবাই জানেন। ২০২০ সালের করোনা সংক্রমণে যে সমস্যা তৈরি হয় সেখানে সবচাইতে বিপাকে ছিল দেশের অগণিত শিক্ষার্থী। তেমন শঙ্কা, উদ্বিগ্ন আর ক্ষতিপূরণ কাটাতেও সংশ্লিষ্টদের সময়, শিক্ষাবর্ষ সবকিছু থেকে পিছু হটার দুঃসময় আজও তাড়িয়ে বেড়ায়।

আজকের উদীয়মান শিক্ষার্থী আগামীর বাংলাদেশের নতুন পথ চলার নির্ভীক, সাহসী যোদ্ধা। বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে নাশকতা, অনাসৃষ্টি শুরু হয় সেখানে সবার আগে বন্ধ করে দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

যা করোনাকালেও চরম ছোঁয়াছে ব্যাধিকে এড়াতে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের ওপর রুদ্ধতার চাপ তৈরি হয়েছিল। অগণিত শিক্ষার্থী পাঠক্রমের মূল বিষয় থেকে ছিটকে পড়ে। করোনাকালে প্রযুক্তির আঙিনায় পাঠক্রম শুরু করা গেলেও নানা নেতিবাচক অনভিপ্রেত বিষয়ও ওঠে আসতে দেরি হয়নি। শিশু-কিশোর থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সেভাবে না হওয়ার বিসদৃশই উঠে এসেছে।

বরং তাদের যান্ত্রিক কলাকৌশলে আসক্তি বাড়ার যে বিপরীত চিত্র সেখানে অভিভাবক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট আঙিনাও পড়ে চরম বিপাকে। তার দাম গুণতে হয় পরবর্তী কয়েক বছর। তেমন অব্যবস্থা সামাল দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষার্থীর কর্মচাঞ্চল্যে নির্দিষ্ট বলয়টি পূর্ণতায় এগিয়ে যাওয়ার চিত্রও ছিল স্বস্তিদায়ক। সেখানে নতুন করে আবারও বিপরীত প্রবাহ চেপে বসা অগণিত শিক্ষার্থীর আগামীর ভবিষ্যৎ যেন এক দুঃসময় পার করার অবস্থায়।

জাতি গঠনের সম্ভাবনাময় কারিগরদের নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাপথে ব্যবচ্ছেদ কতখানি অশুভ হতে পারে তার হিসাব তো সময়ের কাছে। শিক্ষার মতো নিয়মিত কার্যক্রমকে কোনো বন্ধন জালে আটকে দিলে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, দেশও বর্তমানের সঙ্গে সংযোগ রাখতে পিছনে হটে আসে। যা আগামীর ও প্রযুক্তির বাংলাদেশের জন্য নিয়ামক কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। তার ওপর শিক্ষা কার্যক্রমে এসেছে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি। যার সঙ্গে পরিচিত ও সংযুক্ত হওয়ার অনিবার্য সময়ে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দেশের সার্বিক শুভকর্ম কতখানি প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলা মুশকিল।

মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে মেধা ও মনন যাচাইয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা নতুন কর্মবিধির অনুষঙ্গই শুধু নয়, চ্যালেঞ্জও বটে। এমন সব ভিন্ন মাত্রার নবরূপায়ণে শিক্ষা পাঠক্রম সংশ্লিষ্টদের সাবলীল ও অবারিত হতে বেশ খানিকটা সময় তো লাগছেই। এমন সব আন্দোলনের সূতিকাগার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের ঘটনাবহুল বিষয় নয়। সেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাত্র আন্দোলনের এক অবিমিশ্র ফলশ্রুতি। যার ধারাবাহিকতায় এবারও তেমন দৃশ্য প্রত্যেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বিষয় অবশ্যই আলাদা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে মুখরিত শিক্ষার্থী সমাজ তাদের দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জোটবদ্ধভাবে একত্রিত হয়। কোনো সহিংস নাশকতার ধারে-কাছেও তাদের ন্যূনতম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যে কর্মসূচি পালন করা হয় তা ছিল নির্বিঘœ, নিরাপদ এবং সৌজন্যমূলক। ছাত্র আন্দোলনের ধারাকে বিন্দুমাত্র স্খলন করা হয়নি, যা শিক্ষার্থীর সাংবিধানিক অধিকার। যে কোনো যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য তাদের অবস্থান কর্মসূচি।

সেখানে যে সহিংসতা অনুপ্রবেশ যাদের নাশকতাকারী বলা হচ্ছে তারা তৃতীয় পক্ষ। যাদের সঙ্গে আন্দোলন, সংস্কার কিংবা যৌক্তিক কোনো সম্পর্ক না থাকাও পরিস্থিতির ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের নিরপেক্ষভাবে চিহ্নিত করাও জরুরি। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে প্রতিহিংসার তা-ব চালানো হয় সেখানে শিক্ষা খাতকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে ধারণার অতীত। এমনিতে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজটে আক্রান্ত। আর শিশু-কিশোরদের নিত্য পাঠক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঘাত কোনোভাবেই উদ্ভূত সমস্যার অনুকূলেই নয়।

বিষয়টা গভীর এবং সুদূরপরাহত। গুরুত্বপূর্ণ এমন উন্নয়ন সূচক যদি দীর্ঘসূত্রতার জটে আটকে যায় তাতে ক্ষতির যে আশঙ্কা দেশের ভাবী প্রজন্মের তা পোষাণোও কঠিন হবেÑ এমনটি ধারণা করছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞজনরা। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবক থেকে আরম্ভ করে শিক্ষকম-লীও চিন্তিত, উৎকণ্ঠিত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন আমাদের আবহমান বাংলা। খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, তাপপ্রবাহ এবং শৈত্যপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক বিষয়গুলোও খুদে শিক্ষার্থীর জন্য এক প্রকার চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। সবার আগে শিশুদের নিরাপত্তায় প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়।

কোমলমতি শিশুদের স্বাস্থ্যগত কারণে তাদের বিভিন্ন নিসর্গের বিপন্নতা থেকে সুরক্ষা দিতে হয়। সঙ্গত কারণে তারাই প্রাসঙ্গিক শিক্ষাপাঠ থেকে দূরে সরে যায়। পরিস্থিতি মাধ্যমিক পর্যায়ের ষাণ¥াসিক পরীক্ষার মূল্যবান সময়। তা স্থগিত করাও অপরিহার্য হয়ে যায়। তবে শিশু-কিশোরদের উঠতি বয়সের সময়কাল অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ভালো-মন্দ নিরপেক্ষ। ন্যায়-অন্যায় বোধও সেভাবে কাজ করে না। কোনো বিরতি বা ব্যবচ্ছেদে তারাই সবার আগে পিছু হটে। ঝরে পড়ার আশঙ্কাও বিচলিত হওয়ার মতোই।

বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা আপাতত স্থগিত করার বিপরীত কর্মযোগ। প্রাতিষ্ঠানিক বলয়কে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে সুরক্ষিত রাখতে এছাড়া অন্য কোনো বিধি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতের নাগালের বাইরে। এদিকে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠও হরেক আন্দোলন-কর্মসূচিতে কিছুটা উত্তাল। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আন্দোলনে নেমেছেন আরও আগে। তাদের দাবি ন্যায্য অধিকার নিয়ে। ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার অগণিত শিক্ষার্থী।

যা জাতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল বার্তা নয়। আন্দোলনের হাওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অবসর সময় কাটাচ্ছেন না মোটেও। তারাও সরবে মুখরিত হয়ে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দাবি-দাওয়াকে সামনে নিয়ে আসছেন। মাঝখানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পেছানো মানে উচ্চশিক্ষায় অনুপ্রবেশের সময়ও দীর্ঘায়িত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল কর্মযোগ তার আঙিনায় অতিসত্বর ফিরে আসাও পরিস্থিতির অনিবার্যতা। তবে মাঝখানে সহিংস দাবানলে কত মায়ের কোল যে খালি হয়ে গেল তার হিসাব ক্রমান্বয়ে উঠে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সর্বাধিক গুরুত্ব বিবেচনায় সব দাবি মেনেও নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের জের হিসেবে সংশ্লিষ্ট সব প্রাতিষ্ঠানিক বলয় অনির্ধারিত সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে ভাবা অনিবার্য। তবে সংস্কার আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়ে কোটা সংস্কারকে স্বাগতও জানায়। পরবর্তীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলা নিয়ে কর্তৃপক্ষের গভীরভাবে চিন্তা করা পরিবেশ পরিস্থিতিকে সহনীয় করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া উচিত।

করোনার বহুল সংক্রমণকে ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার যে বিপন্নতা তৈরি হয় তার মাশুল গুনতে হয় শুধু শিক্ষার্থী নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাপনাকে। যার সঙ্গে অনবচ্ছেদভাবে জড়িয়ে যায় দেশের উদীয়মান প্রজন্মের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ। উন্নয়ন যাত্রার মূল্যবান সূচকটি অনাবশ্যকভাবে কোনো রুদ্ধতার জালে যেন আটকে না যায়। শিক্ষা কার্যক্রম এমন এক দৈনন্দিন কার্যবিধি যেখানে সামান্য বিচ্যুতিও দেশের আগামীর প্রজন্মকে জটিল অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অরাজক পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের যে মাত্রায় পশ্চাৎগামী করে সেখানে বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও নেই। সবাই প্রত্যাশা করছে শিক্ষার মতো সর্বজনীন ও অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি যেন অনাবশ্যক কোনো জালে আবদ্ধ না হয়। তাহলে শুধু কি উদীয়মান প্রজন্মের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ? তার চেয়ে বেশি জাতির মেরুদ-ের শক্ত ভিতকে একেবারে যেন নাড়িয়ে দিতে না হয়। অগণিত শিক্ষার্থী এই মুহূর্তে অলসভাবে বাসায় সময় নষ্ট করার মতো দুরবস্থায়। এমনিতে উদীয়মান প্রজন্ম হরেক বিপন্নতার জালে আটকে পড়ে। যেখানে চরমভাবে দৃশ্যমান হয় কিশোর অপরাধের মতো বয়ঃসন্ধিকালের দোলাচল। স্পর্শকাতর এমন অসময়ে শিক্ষা কার্যক্রমই যথার্থ সমাধান।

আন্দোলন প্রায় থেমে গেছে। নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের আটক করাও দৃশ্যমান। নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় যথার্থ অপরাধীরাই যেন শাস্তির আওতায় আসে। সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধীর কোনো দল নেই। রাজনৈতিক আদর্শ তো নয়ই। তার একমাত্র মৌলিক পরিচয় সে হামলাকারী আগুনের লেলিহান শিখার যথার্থ সহযোগী অপশক্তি। এখানে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, জাতির প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা। সেটা সব দেশপ্রেমিক মানুষের।
দেশটা সকলের। সুতরাং সংঘবদ্ধভাবে সুস্থ, স্বাভাবিক মৌলিক চিন্তায় সব অপশক্তিকে সমূলে বিনাশ করাও দেশের স্বার্থেই নিতান্ত জরুরি। দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার একটি নিরাপদ, নিঃশঙ্ক, নির্বিঘœ সামাজিক বলয়। যা সব মানুষকে এক সুতায় বেঁধে রাখবে আপন জন্ম আর মাতৃভূমির সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণে। ত্রিশ লাখ শহীদানের পুণ্য স্মৃতিতে অম্লান আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।

যে কোনো অপশক্তিকে ঘায়েল করা মুক্ত বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য কর্মযোগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেভিংসন বলেন, স্বাধীনতাকে নাকি নিত্যপ্রেমের মতো জয় করতে হয়। সামান্য গাফিলতিতে যেমন প্রেমকে হারাতে বসে, স্বাধীনতাকেও নাকি সেভাবে হারাতে হয়। এমন সংগ্রাম নাকি কখনোই শেষ হয় না।

লেখক : সাংবাদিক

মন্তব্য করুন