শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষকদের কি ‘গিনিপিগ’ বানানো হচ্ছে

নাসরীন সুলতানা
  ১১ জুলাই ২০২৪, ০০:০৭
নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আমার জীবনের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প দিয়ে শুরু করি। যদিও গল্পটি আমার ছাত্রছাত্রীদের অনেকবার বলেছি, আজ মনে হলো পাঠকদেরও এ গল্প থেকে শিক্ষণীয় আছে। দুই বন্ধু একসঙ্গে মাছ ধরতে যায়।

প্রথম বন্ধু খুব কৃপণ এবং বোকা প্রকৃতির। সে বেশি খরচ করতে চায় না। তাই ছোট ছোট বড়শি নিয়ে বসে। প্রতিটি বড়শিতে অল্প অল্প করে খাবার দেয়। একটু পরপর তাতে পুঁটি মাছ, ছোট ছোট পোনা মাছ উঠতে থাকে।

সে খুব আগ্রহ নিয়ে হাসিমুখে বড়শির ছিপে টান মারে। কখনো বড়শিতে পুঁটি মাছ বা পোনা মাছ উঠে আসে; কখনো পানিতে শব্দ করে উঠে আসে খালি বড়শি। তার বড়শিতে বারবার টান পড়ছে দেখে সে মনে মনে ভীষণ খুশি। সারা বিকেল শেষে সে ১০ থেকে ১৫টি পুঁটি আর পোনা মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে।

অন্যদিকে দ্বিতীয় বন্ধু অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও কৌশলী। সে মাত্র দুটি বড় বড়শি নিয়ে বসে। বড়শিতে মাছের খাবার গেঁথে পানিতে ফেলে প্রথম বন্ধুর পুঁটি মাছ ধরা দেখতে থাকে। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে ঠিক সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে চার থেকে পাঁচ কেজি ওজনের বিশাল একটি রুই মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও এমনই—বড়শি দিয়ে মাছ ধরার মতো। এতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে দিন শেষে তার ফল বিশাল বড় হয়। আর বিনিয়োগ কম করে খুব অল্প সময়ে ফলাফল প্রত্যাশা করলে ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি মাছের মতো শ্রমিকশ্রেণি তৈরি হয় ঠিকই, তাতে সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনসম্পদ তৈরি হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম চালু করা মানে হলো প্রথম বন্ধুর মতো পুঁটি মাছ ধরার মতো অল্প খরচে ঝাঁকে ঝাঁকে উচ্চশিক্ষিত বানানোর পরিকল্পনা, যা দিয়ে টেনেটুনে বাকি জীবন বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করা যাবে ঠিকই, বড় বড় গবেষক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী সমন্বয়ে একটি উন্নত প্রজন্ম তৈরি করা যাবে না।

সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানসহ ৪০৩টি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১ জুলাই থেকে এই স্কিম চালু করা হলে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একযোগে কর্মবিরতি শুরু করেন। শুধু প্রত্যয় স্কিম বাতিল নয়, তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন আলাদা বেতন স্কেলের দাবিতেও। শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

এ আন্দোলনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি কিংবা মৌন সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর জন্য অবশ্য শিক্ষকেরাই দায়ী।

কথিত আছে, গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, দলীয় ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের মধ্যকার পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে সাধারণ জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে; নষ্ট হয়েছে ছাত্র-শিক্ষকের আন্তসম্পর্ক। এ কারণে নিম্নগামী হচ্ছে শিক্ষার মান, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

তবে এর জন্য গোটা ব্যবস্থাকেই দায়ী করতে হয়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য কোনো চাপ নেই, নেই কোনো সুযোগের ব্যবস্থাও। মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজন লেকচারারকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও খরচে পিএইচডি অর্জন করতে হয়।

একদিকে পরিবারের দায়িত্ব, অন্যদিকে নিজের উচ্চশিক্ষার চাপ, আপগ্রেডেশনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক প্রকাশনা, সেই সঙ্গে সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটি কোর্সের পাঠদান একজন শিক্ষককে সব সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত করে রাখে। কিন্তু আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা ভুলে যান যে শিক্ষকের মানোন্নয়ন না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীর শিক্ষা যদি অসম্পূর্ণ হয়, তবে দিন শেষে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ হিসাব আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বোঝেন না, তেমনটিও নয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত জ্ঞান অসম্পূর্ণ জেনেই হয়তো সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদেশে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য বিশেষ ফেলোশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার নামে দেশ থেকে অনেক টাকা বাইরেও চলে যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র চাইলেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর অন্তত পাঁচজন করে বিশ্বমানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারত। শিক্ষকদের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিকেশনের খরচ বহন করে আপগ্রেডেশনের নিয়মে এগুলোর বাধ্যবাধকতা আনতে পারত।

এতে একদিকে যেমন শিক্ষকেরা সময়ের অভাবে জাতীয় রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতেন, অন্যদিকে তেমনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম হয়ে উঠত; শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো নিজেদের মানোন্নয়নের প্রতিযোগিতা ও জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতা নিয়ে।

কিন্তু পরিস্থিতি আজ বিপরীত দিকে প্রবহমান। শিক্ষকদের গবেষণা ও পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত কারিগরী সহায়তা ও সুবিধা পরিবর্তে সর্বজনীন পেনশনের নামে বিদ্যমান কিছু সুবিধা তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, নতুন এই পেনশনন-ব্যবস্থা প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী চাকরিজীবন শেষে অবসরে শিক্ষকেরা এককালীন কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না। তার পরিবর্তে ৩০ বছর চাকরি শেষে প্রতি মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা বেতন পাবেন।

পাবেন না কোনো ধরনের উৎসব ভাতা বা নববর্ষের ভাতাও। এর বিপরীতে চাকরিরত অবস্থায় তাঁর প্রতি মাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা পেনশন খাতে কেটে নেওয়া হবে, যাকে বলা হয় ফান্ডেড পেনশন প্ল্যান।

অতএব এটা স্পষ্ট যে এই প্ল্যান কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা মর্যাদা ও আকর্ষণ হারাবে। মেধাবীরা এ পেশায় আসার তাগিদ বোধ করবেন না, মেধাবী শিক্ষকের অভাবে সঠিক পাঠদান ব্যাহত হবে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের প্রতিটি খাত মেধাশূন্য হয়ে পড়বে।

ফলে আপাতদৃষ্টে এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন মনে হলেও রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষকদের এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা উচিত। কারণ, প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের মৃতপ্রায় উচ্চশিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখার নামান্তর বৈ অন্য কিছু নয়।

অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীসহ অনেক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী শিক্ষকদের এ দাবি অযৌক্তিক। তাঁদের মতে, নতুন এই পেনশন প্ল্যানে শিক্ষকেরা আরও বেশি লাভবান হবেন। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এত দিন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য চাকরিতে প্রবেশকালে একই বেতন স্কেল বিদ্যমান ছিল।

যদিও অনেক পেশাজীবীর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আছে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং, গাড়ির লোন এবং তা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ, বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট কেনার সুবিধাসহ বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ।

অথচ শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা একক কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা নেই। এমনকি মাস্টার্স বা পিএইচডি অধ্যয়নকালে তাঁদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের মতো ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্তুতও করা হয় না। ফলে লেকচারার হিসেবে যোগদান করার পর অনেক শিক্ষকই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও অর্থের জোগানের অভাবে নিজের সম্ভাবনাকে হারিয়ে ফেলেন।

অনেক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী এই পরিকল্পনা শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। অথচ রাষ্ট্রের সব সুবিধা গ্রহণের বেলায় একটি বিশেষ পেশাজীবীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও এমন লাভজনক পরিকল্পনা তাঁরা সবার শেষে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন বৈষম্যের।

বস্তুত কোনো বাবুর্চি যখন রান্না করেন, তাঁর রান্না করা খাবার তিনি নিজে প্রথমে স্বাদ নেন। এরপর যখন তিনি বোঝেন লবণ–ঝাল সবকিছু ঠিক আছে, তখনই তা অন্যকে পরিবেশন করেন। কিন্তু এ পরিকল্পনার প্রস্তুতকারী নিজেরা পরখ না করেই ‘গরিব’ শিক্ষকের ওপর এটি চাপিয়ে দিচ্ছেন। তবে কি শিক্ষকেরা এ পরিকল্পনায় গিনিপিগের ভূমিকা পালন করছেন?

নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা

ই-মেইল: [email protected]

মন্তব্য করুন