শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষকের ভালোবাসা: এক নীরব বিপ্লব

রহমান মৃধা|
  ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৮:১৫ | GMT +6
ছবি- সংগৃহীত

ছোটবেলার মতো এখন কেউ আমাকে বলে না কী করতে হবে। আমি নিজে যা ভালো মনে করি, তাই করি। কেউ আমাকে অনুপ্রেরণা দেবে, এটা আমার কাম্যও নয়। বরং নিজেই অনুপ্রাণিত হই এবং ভালো কিছু দেখলে বা জানলে ভালো কিছু করতে চাই। আমি যদি নিজেকে ভালো না বাসি, তবে অন্যকেউ বলবে না কোনোদিন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’।

কারণ এমন একটি কথা বলতে দরকার সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। এসব গুণ অর্জন করতে হয় ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে। যার হৃদয়ে আছে ভালোবাসা, সে জানে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ভালোবাসার।

আমি দেশের শিক্ষা এবং শিক্ষকদের নিয়ে বেশ লিখেছি। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। কখনও কঠোর, কখনও নরমভাবে সমালোচনাও করেছি। শিক্ষার অবনতির পেছনে বিভিন্ন কারণ জড়িত, যার মধ্যে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং তাদের দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগ, তাদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বাবা-মায়ের সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সরকার তার সাধ্যমতোত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন শিক্ষার মান উন্নত করা যায়।

পরিবর্তন আনতে সময়, ভালো পরিকল্পনা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। প্রতিটি ভালো কাজ কোনো না কোনোভাবে শুরু হয়। কখনও তা সঠিক সময়ে হয়, কখনও দেরিতে, আবার কখনও কিছুটা আগে। যেকোনো কিছুর শুরু হলে, তার শেষও হয় কোনো এক পর্যায়ে।

কয়েক বছর আগের কথা। হঠাৎ আমার স্কুল জীবনের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের আর্থিক দুরাবস্থা দূর করতে দূরপরবাস থেকে সমাজ, দেশ ও বিদেশে সাড়া দিয়েছিলাম। সেই যে সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছি সেটা কিন্তু এখনও চলমান নানাভাবে। হয়তো এমনটিই ছিল নিয়তির খেলা। গোপাল স্যারের অছিলায় শিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, যা মিরাকেল হয়ে আমাকেও বদলে দিয়েছে।

গোপাল স্যার কখনো কাউকে বলেননি তার কষ্টের কথা। আমাকে কেউ কখনও জোর করেনি স্যারের জন্য কিছু করতে বা স্যারকে নিয়ে ভাবতে। বিবেক যখন তাড়া দিয়েছিল, তখন সাড়া দিয়েছিল অন্তর। আর অন্তর ছিল সুন্দর, তাই পেরেছিলাম কিছু করতে স্যারের জন্য সবাই মিলে। গোপাল স্যার ৪০ বছর একটানা শিক্ষকতা করেছেন, জীবনে বিয়ে করেননি। এরপর অবসরে জীবন কাটছিল ভাঙাচোরা একটা কুঁড়ে ঘরে তার একমাত্র প্রতিবন্ধী ছোট ভাইকে নিয়ে।

কারো কাছে জীবনে হাত পাতেননি, কখনও মাথানত করেননি। কাউকে পরোয়া করে কথা বলেননি। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায় স্যারকে একটি বাড়ি করে দেবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। স্যারকে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তা আমি জানি। আমাদের ছিল ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার কাছে স্যার শেষ অবদি নতি স্বীকার করেছিলেন।

আমরা মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার গঙ্গারামপুর হাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা স্যারের জন্য যা করেছিলাম, তার সামাজিক, নৈতিক ও আদর্শিক মূল্য ছিল অপরিসীম। স্যারের জন্য হৃদয় দিয়ে কিছু করার মধ্যে নিহিত ছিল একটি চিন্তা, একটি বিশ্বাস, একটি মূল্যবোধ, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি দর্শন ও একটি সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু শিক্ষক অসহায় জীবনযাপন করছেন। আমাদের দৃষ্টান্তমূলক কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো অসহায় শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের প্রিয় শিক্ষকের পাশে দাঁড়ায়, তার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে, তাহলেই আমাদের চিন্তা পুষ্টিলাভ করবে। আমাদের বিশ্বাস সুদৃঢ় ভিত্তি পাবে। সমাজে মূল্যবোধ বিকশিত হবে। মানুষের মধ্যে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের দর্শন বাস্তবরূপ লাভ করবে। ফলে আমাদের প্রয়াস একটি সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করবে।

আমরা যখন স্যারের ঘরটি তৈরি করলাম, তখন সেই বাড়ির চাবি আরেকজন আদর্শ শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা সাধন কুমার ভট্টাচার্যের বিধবা স্ত্রী অর্চনা রানী ভট্টাচার্য গোপাল স্যারকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেটাও ছিল আরেকটি মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। গোপাল স্যার এখন আর সেই বাড়িতে শুয়ে বসে সময় কাটান না। তিনি কয়েক বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

বর্তমানে বাড়িটিতে তার প্রতিবন্ধী ছোট ভাই থাকেন। তিনি ভালো আছেন, এ খবর যখন পাই, তখন মনের মধ্যে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করে। তবে ওই সময় একজন শিক্ষকের প্রতি তার ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা হঠাৎ করে একদিনে গড়ে ওঠেনি। স্যার ৪০ বছর ধরে যে নিষ্ঠা ও সততা, কর্তব্য ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে এসেছেন, সেটি ছিল তার প্রতি তার শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার ভিত্তি। বর্তমান যুগে এমন শিক্ষক কোথায় পাবো এমন একটি প্রশ্ন আমাকে করেছে বাংলাদেশ থেকে।

প্রায় ৭ বছর পর ফিরে এসেছে সেই জুলাই মাস। কয়েকদিন ধরেই স্যারের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ স্যারকে নিয়ে একটি পোস্ট আমার ফেসবুকে ভেসে উঠেছে। সেটা পড়তেই মনে পড়ে গেলো সেই ১৯৮২-৮৩ সালের কথা। আমি পড়েছি গঙ্গারামপুর স্কুলে গোপাল স্যারের কাছে। ভাবনায় এসে গেলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের কথা আবারও। কেমন শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই আর সেরকম শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কেমন শিক্ষক প্রয়োজন? গোপাল স্যার ও সাধন স্যারের মতো হৃদয়বান শিক্ষক এখন কোথায়? সে রকম শিক্ষক ছাড়া কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়ন কি সম্ভব?

হাজারও প্রশ্নের মাঝে বসে আছি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট বিমানবন্দরে। ঠিক তেমন একটি সময় হঠাৎ দেখা হলো বাংলাদেশের একটি দলের সঙ্গে। তারা সরকারি সফরে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। ঘুরবেন কয়েকটি দেশ। সামান্য সময় কথা হলো। শুধু বলেছি, দেশের টাকায় ঘুরছেন, আশা করি ভালো যা কিছু দেখে গেলেন, একটু চেষ্টা করবেন দেশে গিয়ে তা কাজে লাগাতে।

এতক্ষণ মুখগুলো হাসিতে ভরা ছিল। যখনই দেশের কথা বললাম, তখনই মুখগুলো চুপসে গেলো। তারা দ্রুতই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সরকারি কর্মকর্তারা কেন নিজেদের গুটিয়ে নিলেন, তা আমি জানি না। সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কী এবং এসব কর্মকর্তা সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন কি না, তা আমার জানা নেই।

তারা যদি সে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই জনগণের ভালোবাসা অর্জন করবেন। সেই ভালোবাসা তারা বুঝতে পারবেন অবসর জীবনে। গোপাল স্যার তার ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বেড়াননি। ছাত্রছাত্রীরাই তাকে খুঁজে বের করেছিল। এটি ছিল তার অর্জন। সরকারি কর্মকর্তারাও যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তারাও মানুষের ভালোবাসা পাবেন।

আর তারা যদি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে গোপাল স্যারের মতো হাজারো গোপাল স্যার তৈরি হবে। আর হাজারো গোপাল স্যার তৈরি হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে শিক্ষার্থীরা। আর জাতি পাবে আদর্শ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। সুতরাং, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা, আদর্শ শিক্ষক ও আদর্শ প্রশাসক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই আমরা বহুফুলের সমন্বয়ে একটি ফুলের মালা গেঁথে ভালোবাসার সেতু তৈরি করতে পারব এ বিশ্বাস আমি করি।

মন্তব্য করুন