পরিবেশ-প্রতিবেশ, শিল্প-সংস্কৃতি, আবহমান ঐতিহ্য প্রভৃতি নিয়েই আমাদের চারপাশ। আমরা যখন দেশ ছেড়ে অভিবাসী হই, তখনও আমাদের প্রজন্ম সেই পেছনেই ফিরে তাকাই বার বার।
রাজনীতি, সামজিক মূল্যবোধ, কিংবা শিকড়ের সন্ধানটাই যেন হয়ে উঠে তখন আমাদের অন্যতম প্রধান বিষয়। মাতৃভূমির অস্থিতিশীল রাজনীতির চালচিত্র আমাদের অনেকের রাতের নিদ্রাকে যেমন করে ব্যাহত, ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নে কিংবা বিশ্ব গণমাধ্যমে দেশের ইতিবাচক ইমেজে প্রবাসী মানুষগুলো হয়ে উঠে উৎফুল্ল।
রক্তাক্ত পথ বেয়ে পাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর যখন কেউ আঘাত করে, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা যখন স্বাধীনতার স্তম্ভগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, তখন ঘৃণা আর ক্ষোভে একজন সমাজ সচেতন নাগরিককে ক্ষুব্ধ করে তোলে। পয়লা বৈশাখকে যখন মৌলবাদীরা আঘাত করে, তখন নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ার যেমন শত শত কণ্ঠে সারা পৃথিবীকে জানান দেয় বাংলাদেশের আবহমান ঐতিহ্যের বার্তা, ঠিক তেমনি ব্রিটেনের শহরে শহরে সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশি দলবেঁধে গান গায়, বেজে উঠে তখন বাঙালির চিরচেনা অনুরণন। এই অনুরণনেই মানুষ জেগে উঠে, ক্ষুব্ধ হয়, দ্রোহী হয় কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি ঘৃণা থেকেই একজন অভিবাসীও প্রতিবাদী হয়, হয় সত্যের সন্ধানে বিদ্রোহী মানুষ।
এই অভিবাসী বাংলাদেশিরা তাদের নিজেদের আবাসস্থলটাও এভাবেই বানিয়ে নিয়েছে যেন নিজস্ব একটা জন্মভূমি, ছোট করে বললে বলতে হয় নিজস্ব গ্রাম। বাংলাদেশের বাইরে প্রথম ওল্ডহ্যাম থেকে শুরু করে লন্ডন কিংবা কার্ডিফ কিংবা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে তাইতো গর্ব নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবের স্থায়ী শহিদ মিনার। বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশিদেরই অর্জনের গৌরবময় নিজস্ব ভবন- বাংলাদেশি ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশসনগুলো।
এছাড়াও বাংলাদেশি অধ্যুষিত শহরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন শহর-জেলা-উপজেলা এমনকি গ্রামের নাম নিয়ে নিজের এলাকার জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন। সংগঠনগুলো এখানে যে শুধুই সংস্কৃতির কর্ষণ করছে, তা-ই নয়। এখানকার জীবন সংগ্রামে অধিকাংশ সার্থক মানুষগুলো তাইতো তাদের শেকড়ের অন্য দিকটাও দেখে। দেশকে এই প্রবাসে তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের এলাকা নিয়েও স্বপ্ন বুনে একেকজন প্রবাসী, এবং সেই স্বপ্নের সফল পরিণতির দিকেও আগায় তারা। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এমনকী নিজস্ব উদ্যোগে নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইতিমধ্যে।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি, অভিবাসী বাংলাদেশিদের সমাজবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাবার সফলতার কথা। একটা সুস্থ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়েই এই সংগঠনগুলো কাজ করে যাচ্ছে। কেননা শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, গণসচেতনতা, সুনাগরিকত্ব তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্যেই সামাজিক সংগঠনগুলো এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি মানুষের মাঝে দায়িত্ববোধটা আরও ব্যাপক হওয়াটাই স্বাভাবিক। যা এখানকার বাংলাদেশি জনগোষ্ঠির মাঝে বিস্তৃত হতে থাকে আজ থেকে অর্ধশতকেরও বেশি আগে এই দেশে আমাদের অভিবাসন ভিত্তি পাওয়ার সেই শুরু থেকেই। যা চলছে এখনও আগের মতই।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। নেতৃত্ব মানুষের একধরনের মোহ। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এ ব্যাপারটা বিভিন্ন সময় বিভেদেরও সৃষ্টি করেছে। একেকটা সংগঠন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। শুধু নেতৃত্বের কারণেই জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন সংগঠন কখনো-বা একই নামে, সামান্য শব্দ পরিবর্তন করে।
কোনো কোনো সময় অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাই অনেকেই সংগঠনের বিস্তৃতি নিয়ে সমালোচনা করছেন, যা স্বাভাবিকও। কিন্তু আমার কাছে সেভাবে মনে হয় নি। কারণ প্রত্যেকটা সংগঠনই প্রতিষ্ঠা লাভ করে একেকটা লক্ষ্য এবং আদর্শকে সামনে রেখেই। এমনকী কোনো সংগঠন যখন বিভক্তও হয়, তখনও একটা লক্ষ্য থাকে।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষগুলো। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। এবং একটা প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রম তখন পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ এলাকার উন্নয়নের কাজ তখন প্রতিযোগিতামূলক ভাবেই শুরু হয়। সংগঠনগুলোর মধ্যে সমালোচনা যদিও থাকে, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে রক্তাক্ত হয় না কখনো এ কমিউনিটি। আর সেই হিসেবে যে কোনো সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকে আমি উন্নয়নের আরেক ধাপ এগিয়ে যাবার মাপকাঠি হিসেবেই দেখি।
পৃথিবী যতই প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে, ততই যেন বিশেষত কিশোর-তরুণ এমনকি শিশুরাও আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে। সামাজিক বন্ধনে ভাটা পড়ছে। বন্ধুত্ব-বন্ধন যেন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের কি-বোর্ডের আঙ্গুলে পিষ্ট হতে চলছে ক্রমশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শব্দাচারই হয়ে যাচ্ছে যোগাযোগের সংস্কৃতি। একটা যান্ত্রিক তারুণ্য আমাদের অর্থনীতিতে আনছে ক্রমশই পরিবর্তন, সারা বিশ্বেই রাজনীতির প্রবাহও যেন হয়ে গেছে এই সোশ্যাল মিডিয়াই। এই প্রবাহে পশ্চিমা দেশের রাজনীতি যেমন প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলোর রাজনীতিতেও ঝড়ের মত ধাক্কা দিয়ে যায়, নিয়ে আসে বড় ধরনের পরিবর্তন। যা বাংলাদেশেই দেখেছি গত কয়েক মাস আগে।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিতে যদিও আমরা নিয়ে আসতে পেরেছি ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন, পাশাপাশি যুগের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেন আমরা হারাচ্ছি আমাদের চিরচেনা শৈশব কিংবা যৌবন। যুগের এই আবাহনকে কেউই হয়ত অবজ্ঞা করতে পারছে না, কিন্তু তারপরও জীবনাচারে গোষ্ঠিবদ্ধ সমাজটাকে ধরে রাখা কোনো অলীক গল্প নয়।
বাংলাদেশে পাবলিক লাইব্রেরিগুলো একসময় শিল্প-সংস্কৃতি কর্ষণের মাঠ ছিল, আড্ডায় গমগম করতো এসব পাঠাগারগুলো। সে জায়গাটা এখনও কি আছে, এ প্রশ্ন আমরা আমাদেরকেই করতে পারি। ব্রিটেনের সমাজেও পাঠাগারগুলোতে আগের মত শুধুই গ্রন্থ বিষয়ক কাজ করে না, জনসাধারণকে লাইব্রেরিমুখি করতে কিছু সামাজিক কার্যক্রমও চালানো হয় এতে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এরকম উত্তাল সময়ে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে আছে একটা ভিন্ন চিত্রও। কমিউনিটিতে গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে চলার একটা স্পৃহা আছে, অন্তত কিছু মানুষের উদ্যোগে সংগঠিত হয় বাংলাদেশি মানুষগুলো। সেজন্য আমি আগেই উল্লেখ করেছি, কিছু বাংলাদেশিদের উদ্যোগে বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এরকম সংগঠনগুলোকে অনেকেই ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করলেও এই অভিবাসে এর একটা ব্যাপক ইমপ্যাক্ট যে আছে, তা অস্বীকার করি কীভাবে।
বছরের বিভিন্ন সময় বলতে গেলে প্রতি মাসেই ব্রিটেনের শহরে শহরে জমে উঠে আসর। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোতে জেগে উঠে বাংলাদেশি কমিউনিটি, এতে পারস্পরিক সাক্ষাৎ হয়, গল্প হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে কোলাহল। ইন্টারনেট দুনিয়ার এই সময়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশি সংগঠনগুলোর এই প্রভাব বলতে হবে তথ্যপ্রবাহের বাইরেও সামাজিক বন্ধন মজবুত কিংবা সুদৃঢ় করার একটা বড় মাধ্যম।
লেখক : ব্রিটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।
মন্তব্য করুন