শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

মাঝে মাঝে মনটা ভেঙে পড়ে

শাহানা হুদা রঞ্জনা
  ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:০৩

প্রতিদিন পশুপাখিদের প্রতি নির্মম আচরণের খবর পড়ি, আর মনটা ভেঙে যায়। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন মানুষের প্রতি নির্মম আচরণ দেখে কি আমার কষ্ট হয় না? হয়, খুব কষ্ট হয়। কিন্তু মানুষের প্রতি অত্যাচার, অবিচার ও নৃশংসতার জন্য মানুষের লোভ দায়ী। মানুষ মানুষের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায়, প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং পূর্ব শত্রুতার জেরে সবধরনের অপরাধ করে। কিন্তু ভাষাহীন পশুপাখি কী অপরাধ করেছে? কেন তাদের উপর প্রতিদিন জোর-জুলুম করা হচ্ছে, কষ্ট দেয়া হচ্ছে? মানুষের লোভের কাছে নির্বিবাদী পশুপাখিকেও বলি হতে হচ্ছে।

বাঁশখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তার দাঁত তুলে নেওয়া হয়েছে। পুরুষ হাতিটির বয়স সাত-আট বছর। হাতিটির শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো কিছুর আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। সেটির দাঁত ও নখ তুলে ফেলা হয়েছে। গুপ্ত শিকারীরা দাঁতের জন্য হাতিটিকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে বনবিভাগের লোকজন ধারণা করছেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার। সংরক্ষিত এলাকায় চোরা শিকারীরা এসে হাতি মেরে দাঁত, নখ নিয়ে গেল। কেউ দেখার নেই? নাকি এখানকার লোকজনই এই হাতি হত্যার সাথে জড়িত? তা না হলে একটি সংরক্ষিত এলাকায় এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে কীভাবে? হাতিটির পড়ে থাকা দেখে বুক ফেটে গেল। সামান্য দুটি দাঁতের জন্য তাকে প্রাণ দিতে হলো? মৃত হাতিটির ময়নাতদন্ত করার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমি মনে করি ময়নাতদন্তের চেয়েও জরুরি হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা।

শুধু এখনই না, বছরের পর বছর ধরে সাতকানিয়া, শেরপুর, কক্সবাজারের চকরিয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে হাতি হত্যা করা হচ্ছে। অথচ এই এশীয় প্রজাতির হাতি বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইউসিএন 'মহা-বিপন্নের তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বহুবছর ধরেই হাতি বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করে আসছেন যে এই প্রাণীটিকে রক্ষায় প্রশাসনের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ভ্রূক্ষেপ যে নাই, এর প্রমাণ হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতি হত্যার ঘটনা। রক্ষকই কি ভক্ষক হয়ে যাচ্ছে? এভাবে চলতে থাকলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে হাতিই থাকবে না, তেলাপোকাই একদিন হাতি হয়ে যাবে।

হাতিকে মানুষ মনে করে শত্রু। হাতি তাড়াতে বনভূমিতেই মানুষ আগুন ধরিয়ে দেয়। হাতি খাবারের জন্য লোকালয়ে ঢুকে পড়লে মানুষ বৈদ্যুতিক শক দিয়ে বা পিটিয়ে মেরে ফেলে। অথচ বাংলাদেশে বসবাসের জায়গা, চাষাবাদ, রাস্তা তৈরি করার জন্য মানুষই হাতির আবাসভূমিতে মানুষ ঢুকে পড়ছে ও হাতির জায়গা দখল করছে। হাতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাতিরা বংশ পরম্পরায় হাজার হাজার বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট রুট ধরেই চলাচল করে। সেই বিচরণ ক্ষেত্রে গত দেড়/ দুই দশকের বেশি ধরে মানুষ বসতি গড়ে তুলছে, চাষাবাদ করছে।

হাতি খুব শান্ত স্বভাবের, বুদ্ধিমান ও স্বজন প্রিয় প্রাণী। এরা দলগতভাবে চলাচল করে। তবে হাতি তার বিচরণ-ক্ষেত্রে কিছু পেলেই সেটা ভেঙেচুরে দেয়। হাতি দিনে পাহাড়ে থাকে, রাতে খাওয়ার জন্য নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে আসার পর বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে নিহত হয় এবং মানুষ ভয়ে গুলি করে। হাতি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলেন, হাতি নিরীহ প্রাণী। ওদের চলাচলের স্থান, খাওয়ার জায়গায় মানুষ বসতি গড়েছে বলে সবসময় মানুষের সাথে হাতির দ্বন্দ্ব হচ্ছে, প্রাণ দিতে হচ্ছে হাতিকে। আর চোরা শিকারীরাতো আছেই।

অন্যদিকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সাফারি পার্ক থেকে একসঙ্গে তিনটি লেমুর চুরি হয়ে গেছে। এমন মূল্যবান ও দুর্লভ প্রাণী চুরি হয়ে যাওয়ার ১৫ দিন পার হলেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেনি পুলিশ। পুলিশ হয়তো লেমুর হারানোর বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি। ২০১৮ সালের হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর সঙ্গে দুটি লেমুর উদ্ধার করা হয়েছিল।

বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে সেগুলো অন্য দেশে পাচার করা হচ্ছিল। লেমুর দুটিকে সাফারি পার্কে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করা লেমুর দুটির মধ্যে একটি ছিল মেয়ে ও অন্যটি ছেলে। ওই বছরের নভেম্বরে লেমুর দম্পতির ঘরে দুটি শাবক জন্ম নেয়। গত বছরে একটি লেমুর মারা যায়। এরপর সেখানে তিনটি লেমুর ছিল।

দুর্বৃত্তরা পার্কের বেষ্টনীর নেট কেটে তিনটি লেমুর চুরি করেছে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে নিরাপত্তা বেষ্টনী কেটে দুর্লভ তিনটি প্রাণী নিয়ে গেল, আর কেউ সেটা টের পেলেন না? অবশ্য পাবেনই বা কেমন করে? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পরে পার্কে দুইবার চুরি হয়েছে। তার আগেও হয়েছে। পার্কের সীমানা প্রাচীর নীচু, নেট কেটে চুরি করা সহজ। নিরাপত্তা প্রহরী নেই। ৫ আগস্টের পরে সিসিটিভি ক্যামেরাও ভেঙে ফেলেছে। পার্কে বিভিন্ন জাতের এক হাজার ৩০০টির বেশি প্রাণী রয়েছে। যে কোনো সময় অন্য প্রাণীও চুরি হতে পারে।

একটি পার্কে বা সাফারিতে দুর্লভ প্রাণী থাকার পরেও নিরাপত্তা কর্মীর অভাব থাকবে কেন? কেন গত নয় মাসে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়নি? এই গাফিলতি কি ইচ্ছাকৃত নয়? চুরির ঘটনার ১৪ দিন পর মামলা হলে, চুরি যাওয়া প্রাণী ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা থাকে? ধারণা করা যায়, পার্কের কারো সাথে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সংযোগ রয়েছে। এরাই বাংলাদেশকে বন্যপ্রাণী পাচারের পথ হিসেবে ব্যবহার করছে। আমরা এখনো জানিনা তদন্ত কিছু হচ্ছে কিনা? আর তদন্ত হলেও কোন ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাংলাদেশ কি আদতে সাফারিপার্ক ও চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী ও মানসম্মত কোন দেশ? এখানে পশুপাখি রক্ষায় অনেক আইন আছে সত্য। কিন্তু পশুপাখির প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্বজ্ঞান খুব কম বা নাই বললেই চলে। এর পাশাপাশি পার্ক ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থবল, লোকবল সবকিছুর অভাব রয়েছে। এইতো সেদিন পঞ্চগড় সদর উপজেলা থেকে একটি বিলুপ্ত প্রজাতির নীলগাই উদ্ধার করা হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নীলগাইটি। পরে স্থানীয় শত শত মানুষ হরিণ ভেবে নীলগাইটিকে তাড়া করে। বাধ্য হয়ে প্রাণীটি নদীতে ঝাঁপ দেয় কিন্তু তাও রক্ষা পায়নি সে। সেখান থেকে নীলগাইটিকে ধরে বেঁধে রাখে স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে পঞ্চগড় বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নীলগাইটি উদ্ধার করে পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুস্থ করে নীলগাইটিকে গাজীপুরের সাফারি পার্কে পাঠানো হয়েছে।

এর আগেও কয়েকটি নীল গাঁই আহত ও নিহত হয়েছে মানুষের কবলে পড়ে। বুঝতে পারি না যে, নীল গাঁই মানুষের এমন কী ক্ষতি করতে পারে যে তাকে মারতে হবে, আহত করতে হবে। নীলগাঁই একটি বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী এবং খুব ভীতু। মানুষ দেখলে তারা ভয় পায়। নীলগাঁইটির বয়স দুই আড়াই বছর হতে পারে। মানুষের জীবনে স্বার্থ এত বেশি স্ট্রং যে তাদের মধ্যে মায়া মমতা কম। আর যেহেতু স্বার্থ বাড়ছে, ভালবাসা, মায়া ততোটাই কমছে। কিন্তু পশুপাখির মধ্যে তো স্বার্থপরতা নেই। তারা সহজাতভাবেই শুধু ভালবাসা বুঝে। যেমন হাতিরা ঘুরে ঘুরে তাদের হারানো সাথীকে খোঁজে, কাকেরা দলের কেউ মারা গেলে একত্রিত হয়ে শোক করে, মা কুকুর মৃত সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েই থাকে, ভাবে বাচ্চাটা মনে হয় বেঁচে উঠবে। বিড়াল তার মৃত বাচ্চাকে মুখে করে নিয়ে লুকিয়ে রাখে, কেউ যেন নিতে না পারে। বানরের দল সংঘবদ্ধ থাকে যেকোনো বিপদে-আপদে। ফলের গন্ধে, ফসলের গন্ধে প্রাণীরা লোকালয়ে আসে। বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় পশুপাখির আশ্রয়স্থল ও খাবারের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এই সংকটের কারণেই এরা জঙ্গল থেকে লোকালয়ে চলে আসছে, আর মানুষের হতে আহত ও নিহত হচ্ছে।

মানুষ কেন কোনো কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করে? টিলার ওপরে আশ্রয় নেওয়া শিয়াল, বাগডাসকে মেরেছিল তরুণদের দল, বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেওয়া হরিণটিকে খেয়ে ফেলেছিল মানুষ, মানুষ গন্ধগোকুলকে মেরে ফেলেছে, কুকুরের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছে, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেয়ে ফেলেছে, বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি মেরে ফেলেছে। আজ এরা বিনা প্রয়োজনে পশুপাখি খুন করছে, কাল মানুষ খুন করবে। যেমনভাবে খুন করেছে আবরার, তসলিমা রেনু, বিশ্বজিৎ দাস, দীপন, অভিজিৎ রায় ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে।

জীবের প্রতি দয়ার কথা আমাদের সেভাবে শেখানো হয় না বলেই অসংখ্য নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সেদিনও একটি মেছোবাঘকে অকারণে হত্যা করা হয়েছে। খাবার খুঁজতে খুঁজতে একটি মেছো বাঘ খালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামের সবাই একজোট হয়ে ধাওয়া করে তাকে পিটিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, নিরীহ মেছোবাঘটির মরদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল গাছের ডালে। এরপর কাঁধে তুলে পুরো গ্রাম চক্কর দিয়ে উল্লাস করেছে গ্রামের কিছু তরুণ। ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে প্রচার করেছে তাদের বীরত্বের গল্প।

এর আগে শ্রীমঙ্গলে ধান খেত থেকে আহত অবস্থায় একটি মেছোবাঘ উদ্ধার করা হয়েছিল। যার কোমরে কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি অন্তঃসত্ত্বা গাভী চুরি করে চামড়াসহ গাভীর মাথাটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।

পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। মানুষই এই জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। যেহেতু বাংলাদেশে মানুষের বড় একটা অংশ প্রাণীকুলকে ভালোবাসতে শিখেনি। ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন চিড়িয়াখানাটিতে ভাল্লুক আহত হয়ে পড়ে ছিল কয়েকদিন ধরে। তার দেহ পচে গলে যাচ্ছিল,ভাল্লুকটির কান্নার শব্দে চারিদিক ভারী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো খোঁজ ছিল না। এর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানার পশুপাখির মানবেতর জীবন ও অব্যবস্থা নিয়েও পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু প্রাণীদের জীবনে শান্তি আসেনি। তাই এই দেশে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক রাখারও কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। এগুলো পশুপাখিদের জন্য আসলে কারাগার।

১৫ এপ্রিল, ২০২৫
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন