বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

তর্ক না করে বেকারত্ব কমানোর ঐক্য গড়ে তুলি

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
  ১১ মার্চ ২০২৫, ১১:০৬

প্রতি বছর বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কয়েক মাস আগে থেকে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট চলতি সালের জুন মাসের কোনো একসময় পেশ করা হবে। এটা হবে আমাদের দেশের ৫১ তম জাতীয় বাজেট। এই বাজেট পেশের দিনক্ষণ এখন থেকে গণনা শুরু করে বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও সভা আয়োজনের তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের জাতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির মাত্রার চাহিদা ও অর্থযোগানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটা ভিন্ন। 

এ সময় একটি নতুন বাংলাদেশের ধারণায় তরুণদের ভাবনার সাথে প্রান্তিক ও সাধারণ গণমানুষের চিন্তাধারার ব্যাপক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সাত মাস গত হবার পরও সেটা বিদ্যমান রয়েছে এবং ক্রমাগত লক্ষণীয় থাকায় ২০২৫ সালের বাজেট একটি সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় জনগণের নিকট জাতীয় বাজেটের ধারণা ও অন্তর্বর্তী সরকারের ঈপ্সিত সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন- ইত্যাকার সবকিছু মিলে সামনে একটি বড় জটিল অবস্থা আঁচ করা যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় বাজেট সবসময় উচ্চাভিলাষী টাইপের হয়ে থাকে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, এবারের বাজেট আরো অতিবেশী উচ্চাভিলাষী হতে পারে বলে ধারণা করতে আপাতত দোষের কিছু নেই।

পরিসংখ্যানের দিকে দৃক্পাত করলে আমাদের জাতীয় বাজেটের অঙ্ক এখন অনেক বড় মাপের। গতবছরের মতো এবারেও বার্ষিক জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে বা আরো বেশি ধরা হতে পারে। গত বছরের ৬ জুন ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শিরোনামে জাতীয় বাজেটকে অভিহিত করে পেশ করা হয়েছিল এবং বিশাল স্বপ্নের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দুই মাস না পেরুতেই সেই স্বপ্নযাত্রার ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেছে। যেটা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ আরোপকারী তখনকার নীতিনির্ধারকগণ নিজেরাই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকায় স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি।

গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নিয়মিত কেন্দ্রীয় বাজেটে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে (এমওডি) ৬,২১,৯৪০.৮৫ কোটি টাকা (প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা মন্ত্রণালয়গুলির মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। আমাদের দেশে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে ডিঙ্গিয়ে এটির বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় এখনও খুব বেশি দৃশ্যমান। অধিকন্তু, দিন দিন জননিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী উভয়বিধ বিষয় খুবই নড়বড়ে ও জন ভীতিকর অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। বিপুল অর্থ খরচ করেও সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে টেকসই অবস্থায় দাঁড় করানো খুব দুরূহ হয়ে পড়ছে।

২০২৫ সালের দুইমাসের অধিক সময় কেটে গেলেও শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা কোনোভাবে কাটিয়ে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নাকাল হয়ে পড়ছে এর দায়িত্বরতগণ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস’ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের বাজার সামলানো বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। আরো বহুবিধ বিষয় রয়েছে সেগুলো এখানে উল্লেখ করা অর্থহীন। তদুপরি আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট কেমন হওয়া উচিত সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পওয়া কঠিন হলেও কিছু ইতিবাচক চিন্তাভাবনা তো বের করতেই হবে!

ইতোমধ্যে শোনা যাচ্ছে, ‘আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ হলেই তৃপ্ত থাকতে চান নীতি নির্ধারকরা। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট হতে পারে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে।’ এমন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে এরই মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়।

তবে এবার কেন আগের মতো কোনো গতানুগতিক বাজেট চাই না তা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত দেশে বড় পরিবর্তন সূচিত করেছে ঝলসে ওঠা বিরাট তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা আমাদের সচেতন জনসমাজ। জুলাই ২০২৪ আন্দোলনের মূল কারণ ছিল তাদের চাকুরিতে ঠাঁই না পাওয়ার বড় বেদনার আহাজারি। তারা মনে করেছে উচ্চশিক্ষিত হয়েও বেকার জীবন কার সহ্য হয়? তাই তো চাকুরি নিয়ে সরকারি কোটার অব্যবস্থাপনা অবলোকন করে তারা প্রতিবাদ করার এক পর্যায়ে সরকারের তাচ্ছিল্যপনা শুনে দ্রুত ক্ষেপে ওঠে এবং অতি সহজেই জোটবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।

কারণ বেকারত্বের এই দুরবস্থা বহুবছর ধরে অবলোকন করার পরও বিগত সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় শতাধিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। যেখানে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে ভিসি নিয়োগের সংবাদও হয়তো কারো অজানা নয়। অপরদিকে সরকারি ও বেসরকারি কিছু নিয়োগ ক্ষেত্র তৈরি করা হলেও তাদের বিরাট অংশ সেখানে ঘুস বাণিজ্যের নিকট পরাজিত হতে হতে নিজেদেরকে অসহায় মনে করে এবং জীবনের প্রতি তাদের চরম ঘৃণা তৈরি হয়ে যায়।

অনেক উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বার বার বিসিএস, মেডিকেল, ব্যাংক বীমা, নৌপরিবহন, স্কুল-কলেজ ইত্যাদির নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘৃণ্য দলীয় রাজনীতির নিষ্পেষণে চাকুরি থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। সেসব লোভনীয় চাকুরিতে পদের সংখ্যাও কম। তার উপর নানা শর্তের বেড়াজাল ও বৈষম্য তৈরি হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি খুব কালো হয়ে ঘনীভূত হয়ে পড়ে।

তিন-চার লক্ষ চাকুরি প্রার্থী বিসিএস চাকুরিতে আবেদন করে দুই থেকে তিন বছর অপেক্ষা করার পর শেষমেশ বিফল হলে তাকে শুধু নিয়তির পরিহাস বলা বড়ই নির্মমতা। কারণ, এই নাজুক অবস্থার পিছনে আমাদের দেশে সরকারিভাবে চাকুরি ক্ষেত্র সম্প্রসারণ না করে অহেতুক রাজধানীকেন্দ্রিক শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ব্যবসায়িক অনুমোদন দান ও মেগা নির্মাণ কাজে অর্থ ও সময় ব্যয় করা।

যার প্রভাব জুলাই বিপ্লবের পরেও আরো ভয়ংকর হিসেবে দৃশ্যমান হতে চলেছে। সম্প্রতি একটি প্রথম সারির স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এডহক ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য একজন সেকশন অফিসার নিয়োগ হবার সংবাদ জানার পর গোটা দেশের বেকার শিক্ষিত তরুণরা সেটাকে বাতিল করে নতুন করে সার্ক্যুলার জারি করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি তুলেছে- তাহলে তারাও সেখানে আবেদন করতে পারতো!

অর্থাৎ, উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেকার বসে দিনগুজরান করে চলেছে যারা সংখ্যায় মোট উচ্চশিক্ষিতদের শতকরা ৪২ ভাগেরও উপরে। বেকারত্মের সুযোগে তারা যে কোনো ঠুনকো বিষয় অবলোকন করে রাজপথে নেমে জটলা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মজার ব্যাপার হলেও সত্যি যে, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা মন্তব্য করেছিলেন- ‘তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন শেষ হলে আবারো আগের মতো বেকার হয়ে যাবেন’!

তাই বেকারদের চাকুরি ও কর্মসংস্থানের জন্য বড় বাজেট চাই। শিক্ষিত বেকারদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তারা নিজেদের জন্য, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে না থেকে গঠনমূলক কাজে অংশ নেবার দ্রুত সুযোগ লাভ করাক এজন্য সর্বাগ্রে তাদের কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট নীতিমালা হাতে নিতে হবে। এজন্য আগামী ২০২৫-২০২৬ জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রেখে এবারের বাজেট প্রণয়ন করা জরুরি। সুতরাং, বাজেটের সংস্কার হওয়া উচিত উচ্চশিক্ষিত বেকারদের দ্রুত চাকুরি বা কর্মসংস্কার নিয়ে। এ নিয়ে আমরা আর কোনো ক্রমাগত কূটতর্ক চাই না।

এছাড়া অতিদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সেবা বাড়ানোর বাজেট রাখা প্রয়োজন। পোশাক শ্রমিক ও উৎপাদনমুখী কলকারখানা এলাকায় সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। স্বল্পদামে পণ্যকেনার জন্য ট্রাকের পিছনে প্রতিদিন হুড়োহুড়ি ও হাতাহাতি দেখতে কার ভাল লাগে? সারাদেশে টিসিবির পণ্য সেবা বাড়ানোর বাজেট চাই। বিধবা ও বয়স্কভাতা দ্বিগুণ করার বাজেট থাকা উচিত।

সরকারি কিছু কর্মকর্তার বেতনের বাইরে বাড়তি আয় খুবই বৈষম্যের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন, সরকারি উচ্চপদের এমনকি জেলা পর্যায়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা সিটিং এলাউন্সের নামে বৈষম্যমূলকভাবে অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। কেউ একাই শতাধিক কমিটির সভাপতি বা সদস্য হিসেবে প্রতিটি সভায় আপ্যায়ন ভাতা ও সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করে মাসিক লক্ষ টাকা আয় করে থাকেন। একজন সভাপতি মাসে কয়টি সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করতে পারবেন এবং একই দিনে চার-পাঁচটি মিটিং থাকলে কয়বার আপ্যায়ন ভাতা গ্রহণ করবেন তার বাজেট কে জোগান দেয়? এর নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।

কারও কারও সভায় উপস্থিত না থেকেও সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণের কথা শোনা যায়। যেটা শুধু শ্রুতিকটুই নয় বরং খুবই ন্যক্কারজনক। এসব আয়ের বৈধতা কোন বাজেটে থেকে আসে? এসব অর্থের হিসাব নেয়ার বিধান জাতীয় বাজেটে থাকা উচিত। কারণ, এসব অ্যালাউন্স আমাদের দেশে চরম আয়বৈষম্য ও ক্রয়ক্ষমতা বৈষম্য সৃষ্টিতে রসদ যোগাচ্ছে।

জুলাই বিপ্লবের মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে সারাদেশে চুরি, ছিনতাই, বাসডাকাতি, ধর্ষণ, খুন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণহীন কিশোরদের পাশাপাশি অনেক বৈষম্যপীড়িত বেকার তরুণ, যুবা বাধ্য হয়ে ভয়ংকর অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অপরাধীরা বাড়তে থাকলে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ভয়ংকর সামাজিক ভাঙন সৃষ্টি হতে থাকবে। যা ইতোমধ্যে কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে।

এসময় দেশ ও সমাজকে অপরাধের অতল গহ্বর থেকে টেনে তোলার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজানোর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট চাই। পুলিশের দেড় হাজার পুড়ে যাওয়া গাড়ির সাথে আগামী নতুন বাজেটে আরো অত্যাধুনিক যান ও সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারি চাকুরির সকল সেক্টরে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে চিকিৎসাকে সহজ করা ও বাজারের নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা অত্যাবশ্যক।

এসব বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর আর্থিক খাতে গতানুগতিকতা সংস্কার করার জন্য আগে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও শক্ত কমিটমেন্ট প্রয়োজন। এজন্য অনবরত হঠকারিতামূলক তর্ক না করে বেকারত্ব কমানোর ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। সেই ঐক্যসভায় দেশের সবার কথা মাথায় রেখে একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও পেশের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকা অতি জরুরি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

মন্তব্য করুন