মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১

যেসব নারীর গর্বে বিশ্বে মাথা উঁচু বাংলাদেশের

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:০৯
ছবি-সংগৃহীত

নারী শক্তি এখন আর শুধু ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের নারীরা তাদের সক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে বাইরের দুনিয়ায় সমান পারদর্শিতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ-দেশ, এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও। নারীর ক্ষমতায়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখন বাংলাদেশ।

খেলাধুলা,বিজ্ঞান,গবেষণা,আবিষ্কার,রাজনীতি,প্রশাসন,পররাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। নারীদের জন্যকল্যাণমুখী সরকারের নানা পদক্ষেপ ও নীতির কারণেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছেন তারা।

সেরা নারী পেসার মারুফা আক্তার

মারুফা আক্তার- আইসিসির ২০২৩ সালের বর্ষসেরা নারী উদীয়মান ক্রিকেটার মনোনীতদের তালিকায় উঠে এসেছেন বাংলাদেশি এই নারী পেসার। চারজনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্যরা হলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার ফিবি লিচফিল্ড, ইংল্যান্ডের পেসার লরেন বেল ও স্কটল্যান্ডের অলরাউন্ডার ডার্সি কার্টার। ১৮ বছর বয়সী মারুফা নিজের প্রথম আইসিসি ইভেন্টেই নজর কাড়েন। পরবর্তীতেও বাংলাদেশের হয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে ভালো করে চলেছেন।

জানা যায়, মারুফা আক্তারের জন্ম নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের ঢেলাপীর এলাকায়। বাবা আইমুল্লাহ হক বর্গাচাষি আর মা মর্জিনা বেগম গৃহিণী। মা-বাবা, চার ভাইবোনসহ ছয়জনের বেশ বড়সড় পরিবার। বড় ভাই আল-আমিন অনার্স করছেন নীলফামারী সরকারি কলেজে। মেজো ভাই আহসান হাবিব দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন স্থানীয় কলেজে। তার পিঠাপিঠি বড় বোন মাহফুজা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। গৃহিণী এই বোনের স্বামী কৃষিকাজ করেন। কেবল ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জায়গা-জমি নেই মারুফাদের। ঘরের যেই ভিটে তাও মারুফার নানার দেওয়া। তবে এখন বদলে যাচ্ছে সব। কেবল নিজের পরিবারই নয়, মারুফা বদলে দিচ্ছেন দেশের লাখো মেয়েদের চিন্তাভাবনা। দেখাচ্ছেন নতুন দিনের স্বপ্ন।

মারুফার বাবা আইমুল্লাহ হক বলেন,‘আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ দেশের হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছে, এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে। আমার চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সন্তান মারুফা। বড় সন্তানের নামে কেউ আমাকে এখন ডাকে না। সবাই মারুফার বাবা বলে আমায় সম্বোধন করেন। এই ডাক শুনে আমার আনন্দে বুক ভরে যায়। মারুফার এই পর্যন্ত পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। মেয়েটি আমার খুব কষ্ট করেছে জীবনে। আমার নিজের কোনো জমি কিংবা বসতভিটা নেই। শ্বশুরের দেওয়া বাড়িতে থাকি। অন্যের জমি বর্গাচাষ ও দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছি। আশা করি, সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। এ জন্য সবার দোয়া কামনা করছি।’

তুমুল আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী মারুফার কাছে আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন এখন জাতীয় দলের বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। এই স্বপ্নটা আজকের নয়; সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। কেউ যেন আমাদের এই লাল-সবুজের দেশের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে!’

সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় গাউসিয়া ও সেঁজুতি সাহা

সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট। সাময়িকীটি ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকা প্রকাশ করে আসছে।

২০২৩ সালের তালিকায় উঠে এসেছেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীরা। সেরাদের এ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক- বিজ্ঞানী গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। গবেষণা করেছেন প্লাস্টিক দূষণ এবং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। অণুজীব বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা কাজ করছেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর পরিচালক হিসেবে।

১শ’ বিজ্ঞানীর মধ্যে স্থান পাওয়া দুই বাঙালি বিজ্ঞানীই নারী। এই তালিকায় স্থান পাওয়া সেঁজুতি সাহা মনে করেন, এই অর্জনের ফলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নারীরা বিজ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে এগিয়ে যাচ্ছেন সেই বার্তা পৌঁছে যাবে বিশ্বের কাছে। তবে ভালো লাগার পাশাপাশি কিছুটা ভয়ও লাগছে সেঁজুতির। তার মতে, ‘এতে দায়িত্ব আরও অনেক বেড়ে গেল। তবে আমি বিশেষভাবে আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ,এ স্বীকৃতিটাও এশিয়াভিত্তিক। যা দেশে ফিরে না এলে কখনও সম্ভব হতো না।’

ফোর্বসে নবনীতা

ফোর্বস প্রথমবারের মতো ‘৩০ আন্ডার ৩০ লোকাল টরেন্টো’ তালিকা প্রকাশ করে। ফোর্বসের মতে, বর্তমানে কানাডায় ব্যবসা ও প্রযুক্তি জীবনের কেন্দ্রে অবস্থান করছে টরন্টো। এখানে তরুণরা নানা উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন; যা ভবিষ্যৎ দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেবে। সে কারণেই টরেন্টোর জন্য আলাদা তালিকা করেছে ফোর্বস।

তালিকায় তরুণ গবেষক ও উদ্যোক্তা হিসেবে স্থান পান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নবনীতা নাওয়ার ও থাই বংশোদ্ভূত পিমুয়াপা মানসিয়ংকুল। তারা দু’জন এইচডিএএক্স থেরাপিউটিকস নামে টরেন্টো ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ফোর্বসের মতে, নবনীতা ও পিমুয়াপার এইচডিএএক্স থেরাপিউটিকস প্রথমবারের মতো পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির চিকিৎসা বা ওষুধের উন্নয়নে কাজ করছেন; যা বিশ্বের তিন কোটির বেশি মানুষের কাজে লাগবে। এইচডিএএক্স ২০২৫ সালের প্রথম দিকে রোগীদের আশা জাগানোর মতো ওষুধ তৈরি করতে যাচ্ছে। নারী নেতৃত্বে চলা দলটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা পিএন রোগীদের জীবন রঙিন করে তুলতে পারে। ক্যান্সার গবেষণার সেরা ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে পাঁচ বছরের গবেষণার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এইচডিএএক্স।

বিবিসির ১০০ নারীর তালিকায় জান্নাতুল

২০২৩ সালে বিবিসির প্রকাশ করা বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় উঠে এসেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি। এ তালিকায় স্থান পাওয়া আইভি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়,মর্মান্তিক অগ্নিদুর্ঘটনায় শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া এ তরুণী চিত্রনির্মাতা, লেখক ও অধিকারকর্মী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন।

জানা যায়, ১৯৯৭ সালে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে যায়। এ মর্মান্তিক ঘটনা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি একজন চিত্রনির্মাতা, লেখক ও অধিকারকর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তিনি বলেন, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছি ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ। এ মানবাধিকার সংগঠন দগ্ধ নারীদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে।

আগামীর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি বলেন, ‘যেদিন আমার শরীরে আগুন লেগেছিল, তার আগ পর্যন্ত সব যেন ঠিকঠাকই চলছিল। তারপর বদলাতে থাকে সময়। বদলাতে থাকে শরীরের ভাষা। সেই পোড়ার যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। হয়তো আজন্ম বয়ে বেড়াতে হবে। 

তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি আমি। এ জন্য আমার পরিবারকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারব না। আমি জানি পোড়ার শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার কথা। এই যন্ত্রণা নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেড়ে যায়। সেখান থেকেই ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ-এর যাত্রা শুরু হয়। আগামীতে সংগঠনটির কার্যক্রম আরও বাড়াতে চাই। সেই সঙ্গে নিজেকেও ছাড়িয়ে যেতে চাই সৃজনশীল ও মানবিক কাজ দিয়ে।’

ফুটবলের তারকা সাগরিকা, কল্পনা, সাবিনা-তহুরারা

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নিয়েছেন সাগরিকা। পেয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও। সাফের প্রথম ম্যাচে তার জোড়া গোলে নেপালকে হারায় বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে তার একমাত্র গোলে জেতে বাংলাদেশ। সাগরিকার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে। বাবা লিটন আলী আর মা আনজু বেগম। চা বিক্রি করে সংসার চালানো লিটন আলীর পরিবারে অভাব-অনটন যেন নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে মেয়ে খেলতে চায় ফুটবল।

সমাজের কটু কথার ভয়ে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করতেন বাবা। কিন্তু মেয়ের আগ্রহ আর জেদের কাছে হেরে যান লিটন আলী। বললেন,‘আমরা যে পরিবার,তাতে ফুটবল খেলা একটা বিলাসিতাই মনে হয়েছিল। তাছাড়া আমার একটা শঙ্কা ছিল,ফুটবল খেললে সবাই কী বলবে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি,আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম।’

গত অক্টোবরে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও বেশ ভালো করেছে বাংলাদেশ। প্রথম সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন তহুরা খাতুন। দুই গোল করেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। একটি করে গোল করেছেন মনিকা চাকমা ও মাসুরা পারভিন ।

শহর থেকে গ্রাম; সর্বস্তরেই এখন নারীর অগ্রযাত্রা। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে বাঙলার কন্যা, ভগিনী ও জায়ারা। এ অগ্রযাত্রার যাত্রী যারা তাদের দেখানো পথ ধরে, অদম্য সাহসিকতা ও অনুপ্রেরণায় ভর দিয়ে এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন