শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১

‌‘ছাত্র ভাইদের গুলি করছে, আমি কেন ঘরে থাকব’

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:২৬

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর সহিংস আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রুস্তম।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে রুস্তম গুলিবিদ্ধ হন এবং ৭ টার দিকে শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ রুস্তমের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।

আন্দোলন চলাকালে রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৯ জুলাই শহীদ হন নবম শ্রেণির ছাত্র রুস্তম। ২০ জুলাই সকাল ১১টার দিকে রায়পুরা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

আন্দোলনে অংশ নিতে যাওয়ার আগেই ১৮ জুলাই রুস্তমের গায়ে রাবার বুলেট লেগেছিল। বাবা-মা এটি জানতে পেরে তাকে আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করেন। বাবা-মা তাকে বলেন, ‘তুমি আমাদের আদরের সোনা, তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমরা কী করব?’

আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা দিল রুস্তম তার পরিবারের সদস্যদের বলেন, ‘আবু-আম্মু, আমার কথা শোনো। তোমরা যদি আমাকে ঘরবন্দী করে রাখো, তাহলে এভাবে প্রতিটা বাবা-মা যদি তাদের সোনাকে ঘরবন্দী করে রাখে, তাহলে আন্দোলন করবে কে? আন্দোলন করবে কীভাবে? এভাবে সারাদেশে আমার ভাইদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, আমরা কেমন করে ঘরে বসে থাকব?’

রাজধানীর মিরপুর-২-এর মিরপুর গার্লস স্কুলের পাশে ৭৪১ নং বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ রুস্তমের বাবা মো. মাঈনুদ্দিন এমন কথা জানান।

শহীদ রুস্তম নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা। বাবা মো. মাঈনুদ্দিন (৪০) এবং মা গার্মেন্টস কর্মী মাসুফিরা বেগম (৩৪)।

দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রুস্তম ছিল সবচেয়ে ছোট। বড় বোন কুলসুম আক্তার এ বছর একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং ছোট ভাই মো. জিসান ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। বাবা দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ ঢাকার মিরপুরে একটি টেইলরিং দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন।

রুস্তমের বাবা বলেন, ‘ছেলে আমার জুমার নামাজ শেষে বাসায় এসে বন্ধুদের ফোন পায়। 'মা, আমরা যদি এ যুদ্ধে না যাই, দেশ স্বাধীন হবে কী করে? অধিকার আদায় করতে হবে।' এই বলেই বাসা থেকে বের হয়। সে খুব মেধাবী, সাহসী, প্রতিবাদী ও  নির্ভীক ছিল। পরিবারের চিন্তা না করে দেশের চিন্তাই বেশি করত।

আন্দোলনে গিয়ে নির্দোষ ছেলেটি গুলিতে মারা গেল। সন্ধ্যার পর ছেলের অপেক্ষায় বসেছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় খবর এল, ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।’

রুস্তমের বোন কুলসুম আক্তার জানান, ১৮ জুলাই জুমার নামাজ শেষে বাসায় আসার পর রুস্তম ফোন পেয়ে বাসা থেকে বের হয়। পুরো এলাকায় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। পুরো পরিবার তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল, কখন বাসায় আসবে। হঠাৎ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বন্ধুদের মাধ্যমে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই।

তিনি জানান, আমরা সবাই সন্ধ্যা ৭টার পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি রুস্তমের গলায় গুলির ক্ষত। হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেটবিহীন তাকে রাতের দিকে রায়পুরার বাড়িতে নিয়ে যাই। পরদিন সকাল ১১ টার দিকে জানাজা শেষে দাফন করি।

ঘটনা প্রসঙ্গে কুলসুম বলেন, ‘রুস্তমের বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারি, বিকাল ৫টা ৩৫ মিনিটে শাহ আলী প্লাজার নিচের রাস্তায় পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে ভাই গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে প্রথম ওখানকার আল-হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ওই হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

বাবা মো. মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘ছেলেটি মিরপুর ২ নম্বর ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। অনেক কষ্টের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ঋণে জর্জরিত। তাকে ঘিরে কতইনা স্বপ্ন ছিল। তার কী অপরাধ ছিল যে তাকে গুলিতে হত্যা করা হলো? কার কাছে বিচার চাইব? কপ করবে বিচার, কে দেবে ক্ষতিপূরণ? তাকে আর ফিরে পাব না, রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলের হত্যার বিচার করে, তাহলে তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাব।’

সরকার যদি আমার ছেলেকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমাদের পরিবারটা বাঁচবে। কারণ ওদের তিন ভাই-বোনের লেখাপড়া করাতে গিয়ে আমি এখন টাকা ঋণী হয়ে গেছি,’ বলেন রুস্তমের বাবা।

ভবিষ্যতে আর কোন স্বৈরাচার যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে, এমন ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে শহীদ রুস্তমের বাবা বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারাদেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ও মুক্ত দেশ পেয়েছি। আমি চাই ভবিষ্যতে আর কোন স্বৈরাচার যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে। আবার যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত, তাদের দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া উচিত। শুধু মুখে শহীদ বললেই হবে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার শহীদ মর্যাদা দেওয়া উচিত।’

সহযোগিতার বিষয়েও মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। তবে রুস্তম শহীদ হওয়ার ঘটনায় পরিবার পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি।’

মন্তব্য করুন