সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জাতির পিতা’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মতো কিছু বিষয় বাদ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। একইসঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান বহালের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলের ওপর পঞ্চম দিনের মতো শুনানিতে অংশ নিয়ে বুধবার (১৩ নভেম্বর) এই দাবি জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’২৪-এর জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সংশোধনী বাতিল না হলে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে না।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ১৯ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি চলছে। বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হয়। শুনানি শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এই রুলকে সাপোর্ট করি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধংস করা, ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত করা, সংবিধানের সুপ্রিমেসি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটা সংবিধানের ওপর প্রতারণার শামিল।’
সংবিধানে ‘জাতির পিতা’ যুক্ত করার ব্যাপারে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু জাতির পিতা নিয়ে সিরিয়াস বিতর্ক আছে; এ বিষয়ে জাতি বিভক্ত।’
‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার অবদান অনস্বীকারর্য। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেও উনি অনেক উপরের মানুষ। কিন্তু একজন ব্যক্তি সব কিছু করেছেন– এটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা নয়।’
তিনি বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৈরি করা সংবিধানে ‘জাতির পিতা’ টার্মটি ছিল না। এটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে ঢোকানো হয়েছে; জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এমনভাবে করা হয়েছে যে, তার (শেখ মুজিব) বিরুদ্ধে কথা বললেই রাষ্ট্রদ্রোহ হবে। অথচ তাকে জাতির পিতা বলা সংবিধানের স্পিরিটের পরিপন্থী।”
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বলেছি, সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে। উই দ্য পিপল অব বাংলাদেশ। আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি। এই কথা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে। ‘উইনেস’ থেকে সরে এসে আমরা ‘আইনেস’ এবং বায়োপিক থিউরিতে গিয়েছি। রাজনৈতিকভাবে এটি আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়। এটি আমাদের দেশ-রাষ্ট্র-সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।”
সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ বাতিল চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে ভাষা দিয়ে জাতিসত্তা নির্ধারণ করা হয় না।’
সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য, গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য করা হয়েছে। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থী। এছাড়া সংবিধানের মূলনীতি গণতন্ত্র; সমাজতন্ত্র নয়। আমরা সমাজতন্ত্র বাদ দিতে চাচ্ছি।’
অনুচ্ছেদ ৮-এর বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। (সংবিধানে) আগে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ছিল। এটা যেভাবে আগে ছিল, সেভাবে চাচ্ছি। আর ২ (ক)-তেই বলা আছে, রাষ্ট্র সকল ধর্ম পালনে সমান অধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করবে। অনুচ্ছেদ ৯-এ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর কথা বলা হয়েছে। এটিও সাংঘর্ষিক।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গণতন্ত্রের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। রায়ের জন্যও অপেক্ষা করা হয়নি। এটা সংবিধানের, মানুষের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্য বহাল রেখে আবার নির্বাচন করা অবৈধ; এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান ছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এই বিধান তুলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা গণভোটের এই বিধানটির পুনর্বহাল চাই। যারা নিশিরাতে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এমপি হয়েছিলেন, তাদের ভোটেই এই বিধান বাতিল হয়।’
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে, মৌলিক অধিকার ধ্বংস করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না? এটা সংবিধানের অংশ হিসেবে রাখা যাবে না। পঞ্চদশ সংশোধনী রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ’৯০–এর গণ–অভ্যুত্থান ও ’২৪–এর জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সংশোধনী বাতিল না হলে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এটা নয় যে হাজার হাজার মানুষকে গুম করা হবে, ৬০ লাখের বেশি মানুষকে গায়েবি মামলায় আসামি করা হবে, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হবে। যাদের হাত নেই, এ রকম মানুষকেও আসামি করে বলা হয়েছে তারা বোমা মেরেছেন। হজে থাকা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এসব হতে পারে না।’
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। এরপর ওই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই রাষ্ট্রপতি তাতে অনুমোদন দেন।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এ বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম প্রমুখ।
সেগুলোর ওপর আগামী ১৭ নভেম্বর শুনানির তারিখ রয়েছে। পাশাপাশি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে।
এদিকে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না- মর্মে জারি করা রুলে দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলতে ইন্টারভেনার হিসেবে হাইকোর্টে নিজেদের পক্ষভুক্ত করেছেন চার আইনজীবী। তারা হলেন- ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী, নাফিউল আলম সুপ্ত ও সাইয়েদ আবদুল্লাহ। এখন তারাও এ রিটের ওপর বক্তব্য রাখবেন।
মন্তব্য করুন