যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩১টি শিশুর মধ্যে একটি অটিজমে আক্রান্ত বলে জানিয়েছে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা এই রোগটি। এবার আক্রান্তের দিক থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, ছয় মাসের মধ্যে অটিজমের কারণ নির্ণয় করে সেই ঝুঁকি নির্মূল করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) সিডিসির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অটিজম আক্রান্তের হার বাড়ার এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টি অঙ্গরাজ্য এবং পুয়ের্তো রিকোর ৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের উপাত্ত সংগ্রহ করে সিডিসি। ওই উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই এই তথ্য উঠে আসে।
সিডিসির তথ্যমতে, এর আগে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৬ জনে একটি শিশু অটিজম আক্রান্ত ছিল, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে একজন।
এছাড়া, এশিয়ান বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী, আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা আলাস্কার স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অটিজম আক্রান্ত শিশু দেখা যায় বলে সিডিসির গবেষণায় উঠে এসেছে। পাশাপাশি মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এই সমস্যা আরও বেশি বলে জানা গেছে।
অটিজম আসলে কী
অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বলেন। অটিজমের অনেক ধরনের লক্ষণ আছে। সাধারণত ভাষা ও যেকোনো বিষয় শিখতে এসব বাচ্চাদের বিলম্ব হয়ে থাকে, সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে বেশ সমস্যা লক্ষ করা যায়, তাছাড়া রুটিনের প্রতি অস্বাভাবিক নির্ভরতা দেখা যায় এসব বাচ্চার।
কয়েক দশক আগেও কোনো শিশুর মধ্যে অটিজম আছে কিনা; তা নির্ণয় করা ছিল খুবই বিরল ঘটনা। শুধু যেসব শিশুর যোগাযোগ ও সামাজিকতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সমস্যা হতো তাদেরই পরীক্ষা করে আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা হতো।
এতে আক্রান্তের হারও তখন কম ছিলো। সিডিসির তথ্যমতে নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজারে ১টি শিশুর অটিজম রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যেত। সে সময় থেকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার— এই শব্দগুচ্ছ পরিচিতি লাভ করতে থাকে। এখান থেকেই তীব্র আকারে সমস্যা দেখা না দিলেও সামান্য আকারে যদি অটিজমের দুয়েকটি লক্ষণ দেখা দেয় মানুষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে।
এতেই দেখা যায়, বিপদের জল অনেক দূর এগিয়েছে। ১০ হাজারে একজন আক্রান্ত থেকে সংখ্যাটি একলাফে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তা দেড়শো জনে একজন হয়ে দাঁড়ায়। আর ২০১৮ সালে আক্রান্তের হার বেড়ে হয় ৪৪ জনে একজন। এই সংখ্যা এরপর থেকে আর কমতে দেখা যায়নি বরং বেড়েছে।
অটিজম কেন বাড়ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, মূলত চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতির ফলে অটিজম শনাক্ত বেশি হচ্ছে। তারা জানান, অটিজম নির্ণয় করার কোনো শারীরিক পরীক্ষা নেই। এমন না যে রক্ত বা অন্য কোনো পরীক্ষা করে বের করা যাবে।
একটি শিশু অটিজম আক্রান্ত কিনা তা বোঝা যায় মূলত শিশুটির আচরণ মূল্যায়নের মাধ্যমে। বর্তমানে এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ও সহায়তার পরিধি অনেক বেড়েছে বলে জানান তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের টিকাবিরোধীরা মনে করতেন, শিশুদের জন্মের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের টিকা দেওয়ায় অটিজম আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেনেডি জুনিয়রও এই টিকা বিরোধীদের দলে।
তবে টিকা দেওয়ার সঙ্গে অটিজম আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে সিডিসি ও অন্যান্য স্বাস্থ্য গবেষকরা বেশ আগেই প্রমাণ করেছেন। পরবর্তীতে জিনগত সমস্যা, বাবার বয়স, মায়ের ওজন, ডায়াবেটিস এমনকি নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে অটিজম হতে পারে কিনা তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে।
কিছু গবেষকদের মতে, বেশকিছু কারণের সমন্বয়ে এই সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। উদাহরণস্বরুপ, জৈবিক সমস্যা রয়েছে এমন কেউ ক্ষতিকর কোনো পরিবেশের সংস্পর্শে আসলে সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠতে পারে।
টিকা ও অটিজম বিতর্ক
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেনেডি জুনিয়র ও অন্যান্য টিকাবিরোধীরা বলেন, শিশুদের বিভিন্ন রোগের টিকা দেওয়া হয়, এটি অটিজমকে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি শিশুদের টিকায় ব্যবহৃত থিমেরোসল নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় বলে জানান তারা। এটির কারণে বাচ্চারা অটিজম আক্রান্ত হন বলে মত দেন তারা।
তবে এই রাসায়নিক এখন আর শিশুদের টিকায় ব্যবহার করা হয়না বলে নিশ্চিত করেছেন সিডিসির কর্মকর্তারা। পাশাপাশি টিকার সঙ্গে অটিজম হওয়া বা না হওয়ার কোনো সংযোগও তারা খুঁজে পাননি।
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন কেনেডি জুনিয়র। সেখানে অটিজম আক্রান্তে সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন। তিনি জানান, দেশটির স্বাস্থ্য ও মানবসেবা মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে অটিজমের কারণ জানতে বৃহৎ পরিসরে একটি গবেষণা করা হবে।
কেনেডি জুনিয়র বলেন, ‘শতাধিক গবেষক এই গবেষণায় অংশ নেবেন। তারা ছয়মাসের মধ্যে অটিজম হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করবেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা নির্মূল করবো।’
মজার ব্যাপার হলো, এমন এক ব্যক্তিকে এই গবেষণা কার্যক্রমের নেতৃত্বে নিয়োগ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যিনি বারবার দাবি করে আসছেন টিকা ও অটিজমের মধ্যে সংযোগ রয়েছে।
ডেভিড গেইয়ার নামে ওই ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়াই এক শিশুর চিকিৎসা করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মন্তব্য করুন