বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিঅন্যান্যসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

কেন গ্রিনল্যান্ড চাচ্ছেন ট্রাম্প?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১২ মার্চ ২০২৫, ১৩:৪২

দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরেই গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার আগ্রহের কথা জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প। যদিও তার এই মনোবাসনা নতুন কিছু না। প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে তিনি একই চেষ্টা করেছিলেন। তখন তার এই চেষ্টাকে রসিকতা মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সবাই।

গেল ৫ মার্চ কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণে ‘যে করেই হোক না-কেন’ বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি নিয়ন্ত্রণের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এবার তার মনোভাব ও প্রকাশ ভঙ্গি দেখে কেউই আর বিষয়টিকে ঠুনকো হিসেবে দেখছেন না।

গ্রিনল্যান্ড দখলে ট্রাম্পের কেন এই আগ্রহ, অনেকের মনেই ঘুরপাঁক খাচ্ছে সেই প্রশ্ন। কথা হচ্ছে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রই না, আরও অনেক দেশের নজর রয়েছে অঞ্চলটির ওপর। এতে দ্বীপটি নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্বও দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও খনিজসম্পদের ভরপুর থাকার কারণেই পরাশক্তিগুলোর চোখ এখন গ্রিনল্যান্ডের দিকে বলে দাবি করেছেন বিশ্লেষকরা।-খবর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের।

সবই চাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট

ডেনমার্কের স্বনিয়ন্ত্রিত দ্বীপটি নিয়ে ট্রাম্প যেভাবে সরব হয়েছেন, তাতে তার ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতি আগ্রাসীভাবে ফুটে উঠেছে। শুধুই যে গ্রিনল্যান্ডেই থেমে নেই তার লোভাতুর দৃষ্টি, চাচ্ছেন ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ—বিনিময়ে দিতে চাচ্ছেন সামরিক সহায়তা।

এছাড়াও তিনি পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছেন। আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বড় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কানাডাকে করতে চেয়েছেন ৫১তম অঙ্গরাজ্য। বাদ যায়নি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাও, উপত্যকাটিও দখলের পাঁয়তারা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সব নিয়ে তিনি বানাবেন গ্রেট আমেরিকা।

কেন গ্রিনল্যান্ড চাচ্ছেন ট্রাম্প?

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী কৌশলগত অবস্থানে এই দ্বীপটি অবস্থিত। বরফে ঢাকা আর্কটিক অঞ্চলটিতে প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রিনল্যান্ডে লিথিয়াম ও গ্রাফাইটসহ ৩১ ধরনের খনিজের বিশাল মজুদ থাকতে পারে, যা বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাটারি উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। 

বিশ্বের বৃহত্তম এই দ্বীপে মাত্র ৫৬ হাজার মানুষের বসবাস, যাদের মধ্যে অধিকাংশ ইনুইত জনগোষ্ঠীর। গ্রিনল্যান্ড ১৯৭৯ সাল থেকে ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।

উত্তর আটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মধ্যে দ্বীপটির অধিকাংশই সুমেরীয় বৃত্তের উত্তর অংশে অবস্থিত। এটির পশ্চিম দিকে ডেভিস প্রণালী ও ব্যাফিন উপসাগর দিয়ে প্রাথমিকভাবে কানাডীয় সুমেরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং পূর্ব দিকে ডেনমার্ক প্রণালী দিয়ে আইসল্যান্ড থেকে আলাদা হয়েছে।

ভূরাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে নানা উত্তেজনা চলছে, তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খনিজ সমৃদ্ধ এই দ্বীপটির অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে ব্যাপক।

এমন পরিস্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন যে ট্রাম্প; তিনি তো এই কৌশলগত অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চাইবেন, এটিই অনুমেয়।তবে ট্রাম্পের এই প্রস্তাব কিন্তু মিত্র দেশ ডেনমার্ক প্রত্যাহার করেছে। তারা বরং গ্রিনল্যান্ড যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চাইছে, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এদিকে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে এরই মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মুৎসি বোওরব এয়েদে। ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, ‘কালাল্লিত নুনাত আমাদের।’  নিজেদের গ্রিনল্যান্ডিক ভাষায় এই নামেই ডাকেন তারা। যার অর্থ, গ্রিনল্যান্ডবাসীদের দেশ। 

এ ছাড়াও গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় বলেও তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। 

অন্যদের নজরও কেন গ্রিনল্যান্ডে?

মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলটি দিয়ে একটি পথ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত আর্কটিকের বরফ গলে যাচ্ছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে বিশ্বের অনেক দেশ বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে একে নিজেদের সামরিক ও বাণিজ্যিক সুযোগ হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ শক্তিধর দেশগুলো। বরফ গলে যাওয়ায় গ্রিনল্যান্ডের বিপুল খনিজ উত্তোলনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। 
 
পোলার রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপক ডোয়েন মেনেজেস বলেন, ‘আমরা আর্কটিক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হবে গ্রিনল্যান্ডের উত্থান এবং স্থায়ী গুরত্ব সৃষ্টি। পাশাপাশি দ্বীপটির প্রভাব তৈরি হবে সর্বব্যাপী।’

স্বভাবতই গ্রিনল্যান্ডের এই উঠতি প্রভাবের সময়ে এর নিয়ন্ত্রণ অনেকেই নিতে চাইবেন, এমনকি কয়েক ধাপ এগিয়ে কিনতেও চাইবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

আর্কটিক অঞ্চলে বাড়বে প্রতিযোগিতা

স্নায়ুযুদ্ধের পর এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহায়তার ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত থাকলেও, বর্তমানে সেই পট পরিবর্তিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, খনিজ সম্পদের সন্ধান ও ইউক্রেন যুদ্ধ—সবমিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এখন চরমে। এতে আর্কটিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব খাটাতে শক্তিধর দেশগুলো মরিয়া। 

কৌশলগত গুরুত্ব

গ্রিনল্যান্ড কানাডার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত, এবং এর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অংশ আর্কটিক বৃত্তের মধ্যে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি উত্তর আমেরিকার প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

সে সময় যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড দখল করে, যাতে এটি নাৎসি জার্মানির হাতে না পড়ে এবং উত্তর আটলান্টিকের গুরুত্বপূর্ণ নৌপরিবহন রুটগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

যুদ্ধ শেষ হলেও গ্রিনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি বজায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পিটুফিক স্পেস বেস (পূর্বনাম থুলে এয়ার ফোর্স বেস) নামে ওই ঘাঁটিটি থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্রের সতর্কতা, প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

জিআইইউকে গ্যাপ (গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, যুক্তরাজ্য) নামে পরিচিত একটি অংশের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে গ্রিনল্যান্ড। ওই স্থান থেকেই উত্তর আটলান্টিকে রাশিয়ার নৌচলাচল পর্যবেক্ষণ করে ন্যাটো।

আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো—কৌশলগতভাবে আর্কটিক অঞ্চলের সম্ভাব্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের পাশেই অবস্থিত গ্রিনল্যান্ড। সম্ভাব্য বলার কারণ এই যে, এতদিন বরফে আবৃত থাকার কারণে এই পথ বন্ধ ছিল। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলতে শুরু করেছে। 

এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই নৌপথ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ওই নৌপথ দুটি চালু হলে একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে পণ্য পরিবহনে সময় কমে আসবে, অন্যদিকে সুয়েজ ও পানামা খালের সংকীর্ণ পথ এড়িয়ে চলার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। 

যদিও আর্কটিক অঞ্চলের এই নৌপথ ব্যবহার উপযোগী হতে এখনো অনেকটা সময় লাগবে। তবে এরইমধ্যে এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে গ্রিনল্যান্ড।

চীনের আগ্রহ

যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা হবে, সেখানে চীন আসবেই—এটিই এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ দুটি পরস্পরের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যের অঙ্গনে হাজির হয়েছে।

চীন ২০১৮ সালে নিজেদের আর্কটিক অঞ্চলের নিকটবর্তী দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ধারণা করা হয়—অঞ্চলটিতে নিজেদের আধিপত্য বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেইজিং। এ ছাড়াও আর্কটিক অঞ্চলে জাহাজ চলাচলের পথ তৈরির মধ্য দিয়ে ‘পোলার সিল্ক রোড’ গঠিত হবে বলেও জানায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতিটি।

কিন্তু আর্কটিককে মহাসাগরকে আরেকটি ‘দক্ষিণ চীন সাগর’ হিসেবে দেখতে চান না বলে জানিয়েছিলেন তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। পাশাপাশি পোলার সিল্ক রোড প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন তিনি। 

প্রসঙ্গত, প্রশান্ত মহাসাগরের এক গুরুত্বপূর্ণ বলয়ে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগর অর্থনীতি, কূটনীতি ও রাজনীতির দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। চীনের পরমাণু অস্ত্রবাহী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সাবমেরিনের কৌশলগত টহল ও নৌপরিবহনের জন্য সাগরটিতে নিয়ন্ত্রণ চাচ্ছে তারা।

কী চায় গ্রিনল্যান্ড?

গ্রিনল্যান্ডের প্রতি সবার আগ্রহ থাকলেও অঞ্চলটি নিজে কী চায়, তা নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম না। কংগ্রেসে ট্রাম্পের ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পরই সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমেরিকান হতে চাই না, ডেনিসও না; আমরা কালাল্লিত নুনাত (গ্রিনল্যান্ডবাসী)। আমেরিকান ও তাদের নেতাদের এই বিষয়টি বুঝতে হবে। আমরা বিক্রির জন্য না এবং তারা আমাদের নিয়ে নিতেও পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ডবাসীরাই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।’ মুষ্টিবদ্ধ হাতের ইমোজি ও জাতীয় পতাকা দিয়ে ওই ফেসবুক পোস্টটি শেষ করেন গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়াও, সম্পতি জনমত জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ গ্রিনল্যান্ডবাসী যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হতে চান না, তারা বরং ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতা চায়। গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন