ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল থেকে নৌকায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন বিনিয়াম সেমে।ইরিত্রিয়ান ওই তরুণের সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোনও।
নৌকায় আরো অনেক যাত্রী ছিলেন। উপকূলের দিকে রওনা হওয়ার কিছু সময় পর নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় মারা যান বিনিয়ামের ছোট বোনসহ আরো ১১ জন অভিবাসী।
৩ সেপ্টেম্বর অভিবাসীবাহী নৌকাডুবির ঘটনাকে চলতি বছর ইংলিশ চ্যানেলের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হিসাবে দেখা হচ্ছে। নিহত ১২ অভিবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ফ্রান্সের কালে শহরে শত মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।
ওইদিন ১৮ বছর বয়সী বোনকে হারানোর ‘ভীষণ বেদনাদায়ক’ মুহূর্তটির কথা বলছিলেন বিনিয়াম। ৩৪ বছরের এই যুবক তার বোনকে সবসময় বলতেন, হাল ছাড়া যাবে না, কারণ তার সামনে ‘পুরো জীবনটাই পড়ে আছে।’
ইংলিশ চ্যানেলে বয়ে যাওয়া পানিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ মনে হয় বিনিয়ামের কাছে। বলেন, ‘চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেছে, নৌকাটি ডুবে গেছে।’
বোনের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন বিনিয়াম। কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন অন্য হাতে, যেন কোনো একটা অবলম্বন ধরে নিজেদের রক্ষা করা যায়। কিন্তু তীব্র ঢেউ তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিলো।
তিনি বলেন, ‘তারপর উদ্ধারকারী জাহাজ এলো। যখন তারা আমাকে উদ্ধার করছিলেন, আমি আমার বোনকে দেখেছি... সে ততক্ষণে মারা গেছে। এক উপরওয়ালাই জানেন আমি কীভাবে বেঁচে গেছি।’
২০২১ সালের নভেম্বরে ইংলিশ চ্যানেলে নৌকা ডুবে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরপর ৩ সেপ্টেম্বরের এই দুর্ঘটনাই চ্যানেলে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই দুর্ঘটনার জের ধরে এমন বিপর্যয় ঠেকাতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের করণীয় নিয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।
নিয়মিত পথ কঠিন হওয়ায় যুক্তরাজ্যে থাকা আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছাতে মানবপাচারকারীদের অর্থ দিয়ে ফ্রান্সের উপকূল থেকে ছোট নৌকায় চ্যানেল পাড়ি দেন অভিবাসীরা। বছরের পর বছর ধরে এই যাত্রা ঠেকাতে কাজ করে আসছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। কিন্তু এই বিপজ্জনক যাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি এখনও।
তথ্য অনুযায়ী, ২ সেপ্টেম্বর ৩৫১ জন অভিবাসী চ্যানেল পেরিয়ে দেশটিতে পৌঁছেছেন। ওইদিন পর্যন্ত এ বছর ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন ২১ হাজার ৬১৫ জন অভিবাসী।
অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধে চলতি গ্রীষ্মের শুরুতে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা’ বাড়ানোর কথা জানিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার।
ফিরোজ লাজিলির মতো এনজিও কর্মীরা মনে করেন, দুই সরকারের নেওয়া প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। চলতি বছর চ্যানেল মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫, গত বছর এই সংখ্যাটি ছিল ১২।
আন্তর্জাতিক এনজিও ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর প্রকল্প সমন্বয়কারী লাজিলি বলেন, ‘আমরা ক্ষুব্ধ এবং বিচলিত, কারণ আমরা মনে করি যে এই মৃত্যুগুলো ঠেকানো সম্ভব ছিল।’
দাতব্য সংস্থা কেয়ার-ফোর-কালের প্রধান স্টিভ স্মিথ মনে করেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করে ‘এই যাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এসব উদ্যোগ মানুষকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে।’
দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা আরেকজন বলেছেন, উদ্ধারকারী নৌকা হিসাবে প্রথম যেটি ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল সেটি ছিল বেশ ছোট। ওই নৌকায় ৬০ জন মানুষ তোলার ধারণক্ষমতাও ছিল না।
নিজের পূর্ণ নাম প্রকাশ না করে ইরিত্রিয়ার নাগরিক এমানুয়েল বলেন, ‘সেখানে অনেক মেয়ে এবং কম বয়সী ছেলে ছিল। আমি তাদের মারা যেতে দেখেছি।’
অভিবাসীদের যাত্রা ঠেকাতে ফরাসী কর্তৃপক্ষের তৎপরতা রয়েছে। কিন্তু একবার যদি তারা যাত্রা শুরু করতে পারেন, তাহলে নিরাপত্তার অজুহাতে আর কোনো পদক্ষেপ নেয় না ফরাসী কর্তৃপক্ষ। তবে, দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার অভিযানে নেমে পড়ে।
এমানুয়েল জানিয়েছেন, বিপজ্জনক এই ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা তিনি আর করবেন না। কিন্তু মুহাম্মদুল্লাহর মতো কেউ কেউ আছেন, যারা জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও পিছপা হতে চান না।
তালেবানদের হাত থেকে বাঁচতে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন মুহাম্মদুল্লাহ। পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি। ফ্রান্সে থাকতে তার কোনো অসুবিধাও ছিল না, কিন্তু দেশটিতে বসবাসের প্রয়োজনীয় অনুমতি তিনি পাননি। তাই আবারও ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা নিতে চান মুহাম্মদুল্লাহ, সেটাও যতো দ্রুত সম্ভব।
মন্তব্য করুন