সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের দ্রুত পায়ে বাস থেকে নেমে আসা, জুতো-স্যান্ডেলের স্তূপ, টিভি সাংবাদিকদের সরাসরি রিপোর্টিং আর এসবের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকা মানুষের ভিড়। মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাতে এমনটাই ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি হাসপাতালের দৃশ্য।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে এক ধর্মীয় জমায়েতে পদপিষ্ট হয়ে এখন পর্যন্ত ১২২ জনের মৃত্যুর পেছনের কাহিনি শুধু ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই ধর্মীয় জমায়েত, যেগুলো ‘সৎসঙ্গ’ বলা হয়, সেটির আয়োজকরা অনুমতি নিয়েছিলেন ৮০ হাজার মানুষের জমায়েতের। প্রকৃতপক্ষে এর কয়েকগুণ বেশি মানুষ মঙ্গলবার জড়ো হয়েছিল ‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের সভায়।
এই ‘ভোলে বাবা’ কীভাবে ইভটিজিংয়ের দায়ে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে, জেল খেটে বেরিয়ে ধর্মগুরু হয়ে উঠলেন, সেটিও যেন এক সিনেমার গল্প।
এখন ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের খোঁজে তার কয়েকটি আশ্রমে তল্লাশি চালাচ্ছে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। তবে বুধবার যে এফআইআর দায়ের হয়েছে, সেখানে ওই ধর্ম প্রচারকের নাম নেই বলে জানা গেছে।
জেল খেটে বেরিয়েই হয়ে ওঠেন ‘বাবা’
উত্তর প্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে, ‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত নারায়ণ সাকার হরির আসল নাম সুরজ পাল জাটভ।
কাসগঞ্জ জেলার বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা জাটভ উত্তর প্রদেশ পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর পুলিশের স্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ১৮টি থানা এলাকায় কাজ করেছেন তিনি।
২৮ বছর আগে ইভটিজিংয়ের অভিযোগে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল জাটভকে, পরে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত হন তিনি।
ইটাওয়া জেলার জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার সঞ্জয় কুমার জানান, ওই ইভটিজিংয়ের ঘটনায় বেশ লম্বা সময় জেলে ছিলেন সুরজ পাল জাটভ। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ‘বাবা’র রূপ ধরেন তিনি।
বরখাস্ত হওয়ার পরে সুরজ পাল জাটভ আদালতে গিয়েছিলেন নিজের চাকরি ফিরে পেতে। আদালত চাকরি ফিরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে আগ্রা জেলায় কর্মরত অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসর নেন জাটভ।
এরপর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। কিছুদিন পরে হঠাৎ দাবি করতে থাকেন, সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয় তার। এই সময় থেকেই নিজেকে ‘ভোলে বাবা’ হিসেবে তুলে ধরতে থাকেন জাটভ।
দ্রুত বেড়ে ওঠে ভক্তের সংখ্যা
কয়েক বছরের মধ্যে ‘ভোলে বাবা’র ভক্তসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এই ভক্তকুলই তার হয়ে বড় বড় ধর্মীয় জমায়েতের আয়োজন করতে থাকে। ওইসব জমায়েতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করে।
জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার সঞ্জয় কুমার বলেন, ৭৫ বছর বয়সী সুরজ পাল ওরফে ‘ভোলে বাবা’রা তিন ভাই। তিনিই সবার বড়।
নিজের ধর্মীয় জমায়েত বা ‘সৎসঙ্গ’-এ ভোলে বাবা একাধিকবার দাবি করেছেন, সরকারি চাকরি থেকে তাকে যে কে এদিকে টেনে আনল, তা তিনি নিজেও জানেন না।
এ ধরনের স্বঘোষিত ধর্মগুরুদের বেশিরভাগকেই দেখা যায়, ভক্তদের কাছ থেকে বিপুল ধনসম্পত্তি ‘দান’ হিসেবে গ্রহণ করেন।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে ‘ভোলে বাবা’ ওরফে নারায়ণ সাকার ভক্তদের কাছ থেকে কোনো দান-দক্ষিণা গ্রহণ করেন না। যদিও বেশ কয়েকটি আশ্রম তৈরি করেছে তার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট।
অন্য হিন্দু ধর্মগুরুদের মতো গেরুয়া বসন পরেন না ভোলে বাবা। সবসময় তার পরিধানে থাকে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বা জামা-প্যান্ট অথবা স্যুট।
ভোলে বাবার সৎসঙ্গে যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির এবং অনগ্রসর জাতির মানুষ।
স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, ভোলে বাবা গত কয়েক বছরে হাথরাসে বহুবার সৎসঙ্গ করেছেন এবং প্রতিবারই আগেরবারের থেকে বেশি ভিড় হয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক বি এন শর্মা বলেন, বাবার সৎসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, ভিডিও করাও নিষিদ্ধ। তার নিরাপত্তায় সৎসঙ্গীদের একটি বড় দল থাকে, যারা তাকে ঘিরে রাখেন। তাই ভোলে বাবার কাছাকাছি পৌঁছানো বেশ কঠিন।
বিপুল সংখ্যক ভক্ত থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভোলে বাবা’র উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায় না। তার ভক্তদেরও সেরকম উপস্থিতি নেই সামাজিক মাধ্যমে। বাস্তবে লাখ লাখ ভক্ত থাকলেও ফেসবুকে তার জমায়েতগুলোর ‘লাইভ’ প্রায় নেই বললেই চলে।
যেসব সৎসঙ্গ আয়োজন করেন তার ভক্তরা, সেগুলোতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরা। পানি, খাবার, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ- সব কিছুরই দায়িত্ব সামলান তারা।
তবে এর আগেও তার ‘সৎসঙ্গ’-এ অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।
উত্তর প্রদেশ পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া রামনাথ সিং যাদভ বলেন, আজ থেকে বছর তিনেক আগে ইটাওয়া জেলায় ভোলে বাবার এক জমায়েত চলেছিল প্রায় মাসখানেক। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণের সেখানেও হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছিল, ভবিষ্যতে যেন এমন জমায়েতের অনুমতি না দেওয়া হয়।
‘বাবা’র পায়ের ধুলো নিতে হুড়োহুড়ি
মঙ্গলবারের ‘সৎসঙ্গ’-এ হাজির হওয়া ভক্তরা জানিয়েছেন, জমায়েত শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ‘বাবা’র পায়ের ধুলো সংগ্রহ করতে গিয়েই হুড়োহুড়িটা শুরু হয়।
ঘটনাস্থল সিকান্দ্রারাউ শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ফুলরাই গ্রাম। জাতীয় মহাসড়ক ৩৪-এর ধার ঘেঁষে বিরাট এলাকাজুড়ে তাঁবু ফেলা হয়েছিল। এখন দ্রুততার সঙ্গে ওই তাঁবু খুলে ফেলা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বেশিরভাগ মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছে মহাসড়কের পাশের জায়গাটিতেই।
সেখানে ‘ভোলে বাবা’র প্রস্থানের জন্য আলাদা পথ করা হয়েছিল। সৎসঙ্গ শেষ হতেই মহাসড়কের পাশে ‘বাবা’র দর্শনের জন্য বহু নারী ভিড় করেছিলেন। মঙ্গলবার বৃষ্টি হওয়ায় মাটি ছিল ভেজা।
‘ভোলে বাবা’র পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্য নিচে ঝুঁকেছিলেন অনেক ভক্ত। হুড়োহুড়িতে পা পিছলে ওখানেই পড়ে যান বহু মানুষ। একবার যারা পড়ে যান, তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
তবে কথিত ধর্মগুরু ভোলে বাবার ভক্তদের জন্য না থেমে এগিয়ে যেতে থাকেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এই সৎসঙ্গের আয়োজকদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন