ভাগ্য ফেরানোর আশা নিয়ে একবছর আগে মালয়েশিয়া যান নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম। ধারদেনা করে তার খরচ হয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু যে কাজের কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সি, বিদেশি গিয়ে তার বিপরীত কাজে যুক্ত করা হয় সেলিমকে।
‘আমি বলেছিলাম কনস্ট্রাকশনের সাধারণ কাজগুলোতে যেন দেওয়া হয়। কিন্তু ওরা আমাকে শুরুতেই দিয়ে দেয় পাইলিংয়ে হ্যামারিংয়ের কাজ। আমি এটা কোনোদিন করিনি। কিন্তু ওরা আমাকে বাধ্য করে কাজটা করতে। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতো। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
চাপের মুখে কাজ করতে গিয়ে একপর্যায়ে দুর্ঘটনায় পড়েন সেলিম। শুরু হয় শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা। তখন ঠিকমতো চিকিৎসাও পাননি বলে অভিযোগ তার।
‘আমার একপর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে মনে হচ্ছিল আমি মারা যাবো। আমি চেয়েছিলাম দুই/তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে এসে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু কোম্পানি রাজি হয় নাই। পরে আমি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। ওরা শেষ দুই মাসের বেতনটাও দেয় নাই।’
‘আমার তিনটি বাচ্চা আছে, আমি যে মালয়েশিয়া থেকে তিনটা চকলেট আনবো সেটাও পারি নাই। তিনটা পয়সাও আনতে পারি নাই। বিদেশে থেকে মরে যাওয়াটাই ভালো ছিল। বাংলাদেশে বাচ্চাদের না পারছি পড়াশোনা করাতে, না পারছি ভাত-কাপড় দিতে,’ আফসোস করেন সেলিম।
এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ঋণ পরিশোধের চাপ। দিশেহারা সেলিম কীভাবে সেটি পরিশোধ করবেন জানেন না।
প্রবাসে গিয়ে সেলিমের যে অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের অনেকেই তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। দেশটি থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে পরে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন খালি হাতে।
অথচ শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যতো আলোচনা, শ্রমিকদের এরকম শূন্য হাতে ফিরে আসা নিয়ে ততটা আলোচনা নেই বাংলাদেশে।
যদিও গেলো সপ্তাহেই মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফরে আবারো জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
কিন্তু কাতারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছেন? কেন এবং কীভাবেই বা তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন?
‘ফ্রি ভিসা’র গল্প
খাদেমুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। কয়েকমাস আগে শ্রমিক হিসেবে যান কুয়েতে। তবে তার ভিসা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে আসেনি। তাকে ভিসা জোগাড় করে দেন তারই এলাকার একজন কাতার প্রবাসী। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘ফ্রি ভিসা’। অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট কোনো চাকরি নেই, বেতনও নেই। তিনি কুয়েতে যাবেন। কিন্তু কাজ তাকেই খুঁজে নিতে হবে।
এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করবেন কাতারে থাকা পরিচিতরা। মোটামুটি মৌখিকভাবে চুক্তিটা এমনই। বিনিময়ে যে বাংলাদেশি ব্যক্তি কুয়েতি নাগরিকের মাধ্যমে প্রবাসী ভিসা জোগাড় করেছেন, তিনি পাবেন কয়েক লাখ টাকা। এখান থেকে কুয়েতি নাগরিকও পাবেন একটা অংশ।
যেহেতু এভাবে মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া যায় না, ফলে এক্ষেত্রে সহায়তা নেওয়া হয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশীয় কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির।
কুয়েতি নাগরিকের দেওয়া ভিসাকে সামনে রেখে নিয়োগপত্র, আকামা, বেতন, কাজের ধরন, বিমান-টিকিটসহ সকল কাগজপত্রের কাজ করে দেয় রিক্রুটিং এজেন্সি। বিনিময়ে তাদের দিতে হয় আরো কয়েকলাখ টাকা। এই পুরো প্রক্রিয়া পরিচিত ‘ফ্রি ভিসা’ নামে।
খাদেমুল ইসলাম এই ‘ফ্রি ভিসাতে’ই পাঁচ মাস আগে কুয়েত গিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে সাত লাখ টাকা।
কিন্তু যাওয়ার পর তিনি কোনো নির্দিষ্ট কাজ জোগাড় করতে পারেননি। বসে ছিলেন কয়েক মাস। কিছু খুচরা কাজও পেয়েছেন। কিন্তু বেতন কম। খাদেমুল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।
‘কুয়েতে যে এমন অবস্থা হবে আগে বুঝিনি। এখানে কাজ পাওয়া কঠিন। আমার আকামার মেয়াদ (কাজের অনুমতি) একবছর। কিন্তু যে টাকা খরচ হয়েছে, এক বছরের মধ্যে সেটা তোলা সম্ভব না। আর যে কুয়েতি নাগরিক আমাকে নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে কুয়েত সরকার থেকে আমার ভিসা ম্যানেজ করে দিয়েছে, তিনি তো আমাকে চাকরি দেবেন না।’
‘তার কাজ ছিল ভিসা ম্যানেজ করা। বরং এক বছর পর আকামার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আমাকে আবার তার কাছেই যেতে হবে। আবার তাকে কয়েক লাখ টাকা দিতে হবে। এরা আবার অনেক সময় আকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করে না। বরং কুয়েত সরকারের কাছে নতুন কাউকে আকামা দেয়ার জন্য আবেদন করে। তাহলে সে বেশি টাকা পাবে। তখন তো আমাদের অবৈধ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।’
খাদেমুল ইসলাম এখন মনে করছেন, যত টাকা তিনি খরচ করেছেন সেটা দিয়ে দেশেই কিছু একটা করা সম্ভব ছিল।
‘সবাই মনে করে বিদেশে গেলেই টাকা। কিন্তু এখানে কী অবস্থা সেটা কাউকে বলতে পারছি না। গ্রামে মানুষ মনে করছে, আমার পরিবার বড়লোক হয়ে গেছে। আমি প্রচুর টাকা পাঠাচ্ছি। কিন্তু এখানে যে অবস্থা সেটা কাউকে বলতেও পারছি না,’ বলছিলেন ইসলাম।
ব্যর্থ হয়ে ফেরা শ্রমিকের সংখ্যা কত?
কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া, বেতন কম, আকামা নবায়ন না হওয়া, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকেরা ফিরে আসেন।
কিন্তু যখন ফিরে আসেন তখন তারা যথেষ্ট উপার্জন করতে পারেন না। ফলে দেশে ফিরে নতুন করে ভুগতে হয় ঋণ পরিশোধের চাপে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা কত বাংলাদেশে তার কোনো হিসাব নেই।
তবে যেসব শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়ার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন কিংবা অন্য কোনো কারণে গ্রেপ্তার হন তাদের আউট পাস দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এসব আউট পাস নিয়ে ফেরত আসা শ্রমিকের একটা হিসাব আছে। ২০২৩ সালে এ রকম কর্মীর সংখ্যা ৮৬ হাজারেরও বেশি। আর ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ফেরত এসেছে ১৫ হাজার।
সবমিলিয়ে গেলো কয়েক বছরে আউটপাস নিয়ে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার।
যদিও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে।
দায় কার?
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর কাজটি করে মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। নির্দিষ্ট চাকরি, বেতনের অঙ্ক ইত্যাদি উল্লেখ করে চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানো হলেও প্রায় সময়ই কাগজ আর বাস্তবতার মধ্যে মিল থাকে না বলেই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
তবে মূল সমস্যাটা হচ্ছে ফ্রি ভিসার কারণে। রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি বলছে প্রতি বছর যত জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে তার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই যায় ফ্রি ভিসায়। এই যাওয়ার ক্ষেত্রে আবার অর্থের বিনিময়ে তাদের কাগজপত্র করে দিচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
যদিও এজেন্সিগুলো এর পুরো দায় নিতে নারাজ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) এর মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, শ্রমকিদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার একক কোনো কারণ নেই।
‘অনেক শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যে প্রজেক্টে তার কাজ, সেখানে কাজ করছে না। বেশি বেতন পেলে সে অন্য কোনো প্রজেক্টে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আইনগতভাবে বৈধ না। কিন্তু তারা এই ঝুঁকিটা নিচ্ছে। ধরা পড়লে কিন্তু তখন তাদের ফেরত আসতে হয়,’ বলেন চৌধুরী।
‘আর যারা ফ্রি ভিসায় যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে সেখানে টাকাটার লেনদেন হয় মূলত আত্মীয়-স্বজনদের কাছেই। এখানে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু সরকারি আনুষ্ঠানিকতাটা করে দেয়। সুতরাং এখানে পুরো দায়টা শুধু এজেন্সিগুলোকে দিলে হবে না।’
চৌধুরী জানান, বায়রা যদি কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পায়, সেটির সত্যতা থাকলে সেই এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে।
প্রতিকার কী?
শ্রমিকদের অভিযোগ দেখভালের জন্য বিএমইটি কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে অভিযোগ পড়েছে দুই হাজারের বেশি।
তবে এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে অর্ধেকেরও কম। আর জরিমানা আদায় হয়েছে ৭ কোটি টাকারও বেশি। জরিমানার টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভুক্তভোগী কর্মীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে বিএমইটি।
এর বাইরে কোনো কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত করার মতো পদক্ষেপও নেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এসব অনিয়ম আগে থেকেই কেন ধরা পড়ছে না? এসব বিষয় জানতে চাইলে সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে মন্ত্রণালয় থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
যদিও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্লাটফরমের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর শরীফুল হাসান বলছেন, শ্রমিকরা যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, সরকার তার দায় এড়াতে পারে না।
‘প্রতিটা কর্মী যিনি বিদেশ যান, তার বিদেশ যাওয়ার আগে বিএমইটি থেকে একটা স্মার্ট কার্ড বা ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তো সরকারের পক্ষ থেকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার মানেই হলো বিদেশে তার চাকরির তথ্যটা ঠিক আছে, তার কোম্পানিটা ঠিক আছে। তারমানে সরকার যখন বলছে তার সবকিছু ঠিক আছে, তারপরে সেদেশে গিয়ে যদি কর্মী কাজ না পায় বা দেখে যে তার বেতন অনেক কম তখন সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রকারী কর্তৃপক্ষেরই ব্যর্থতা।’
তার মতে, কর্মী, এজেন্সি এবং নিয়োগকারী পক্ষ সবখানেই সচেতনতা এবং স্বচ্ছ্বতা দরকার। আর প্রতারণার যে চক্র গড়ে উঠেছে সরকারকেই সেটি ভাঙতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় প্রতারণা বা জালিয়াতির ঘটনা নতুন নয়। এর সঙ্গে বিশেষত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় উঠে এসেছে শূন্য হাতে শ্রমিকদের ফিরে আসার ঘটনা।
এটি যে শুধু বাংলাদেশের শ্রমখাতেই সমস্যা তৈরি করছে তা নয়, বরং একইসঙ্গে দেশে বেকারত্বের চাপ বাড়িয়ে সমাজ এবং পরিবারেও তৈরি করছে নতুন সংকট।
মন্তব্য করুন