ইউরোপ এবং ফ্রান্সে আসা শরণার্থী এবং অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশে কখনো স্কুলে যাননি কিংবা প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারলেও পড়তে বা লিখতে জানেন না। যেটি ফরাসি সমাজে ইন্টিগ্রেশননের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা।
ফ্রান্সে প্রায় এক শতাংশ নিরক্ষর মানুষ রয়েছে। এসব ব্যক্তিরা প্রায়শই অন্যদের চেয়ে দুঃসহ পরিস্থিতিতে থাকেন বলে ধারণা করা হয়।
প্যারিসের ১৩তম অ্যারোন্ডিসমেন্টের পোর্ত দ্যো সোয়াজিতে অবস্থিত সংস্থা ‘ফ্লো এ কোম্পানি’। এই সংস্থাটি নিরক্ষর অভিবাসীদের ফরাসি ভাষা শেখায়। মঙ্গলবার (২৩ জুন) সংস্থার কয়েকটি কার্যক্রম পরিদর্শন করে ইনফোমাইগ্রেন্টস।
সাদা এবং সবুজ দেয়ালের একটি কক্ষের মাঝখানে রাখা বড় টেবিলের চারপাশে পাঁচজন শিক্ষার্থী ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডি ডিপ্লোমা (ডেলফ ) পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অনুশীলন করছে।
শ্রেণিকক্ষটিতে থাকা শিক্ষার্থীরা ১০০ শব্দের মধ্যে তাদের পছন্দের শহর এবং তাদের দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব বর্ণনা করতে হবে এমন লিখিত ধাপের উপর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ।
মৌরিতানীয় অভিবাসী সিবি (ছদনাম) ২০১৮ সালে ফ্রান্সে এসেছিলেন। শুরুর দিকে বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলের মুরু এলাকায় এক আত্মীয়ের সঙ্গে কয়েকমাস বসবাস করেছিলেন। ফ্রান্সের লে ইভলিন ডিপার্টমেন্টের ওই শহরে সিবির বেশ কিছু প্রিয় প্রিয় স্মৃতি রয়েছে।
অনুশীলনে তিনি স্মৃতি থেকে লিখিত ধাপ বর্ণনার চেষ্টা করছিলেন। তার পাশে ছিলেন আরেক অভিবাসী মরিয়ম। যিনি আফ্রিকার দেশ মালির একটি উৎসবকে তার শেখা ফরাসি শব্দভাণ্ডার দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা করছিলেন।
এই সংস্থায় শিক্ষার্থীদের সবাই বিদেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। তারা তাদের নিজ দেশে খুব কম দিন স্কুলে গিয়েছেন বা কখনো স্কুলে যাননি। যদিও কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস শুরু করার সময় অসুবিধা ছাড়াই মৌখিকভাবে ফরাসি কথা বলছিলেন কিন্তু তাদের লেখার সক্ষমতা ছিল না।
অ্যাসোসিয়েশনটির প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষক এমানুয়েল গোদার ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, যারা জীবনে পাঁচ বছরের কম সময়ের জন্য স্কুলে গিয়েছেন বা একবারেই যাননি তাদেরকে আমরা ‘নিরক্ষর’ বিবেচনা করে সাক্ষরতা কোর্সে ভর্তি করি।
তিনি ২০১৩ সালে অভিবাসীদের ফরাসি ভাষা শেখাতে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ফরাসি পরিসংখ্যান দপ্তর লিনসের মতে, বর্তমানে ৭ থেকে ৬৫ বছর বয়সি ফরাসিদের মধ্যে এক শতাংশ মানুশ নিরক্ষর। তবে ভালোভাবে লিখতে এবং পড়তে পারেন না এমন লোকেদের সংখ্যা ৭ শতাংশ। অপরদিকে, অভিবাসীদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি।
এমানুয়েল গোদার ব্যাখ্যা করেন, “পড়তে এবং লিখতে না পারা অভিবাসীদের জন্য ফ্রান্সে ‘ইন্টিগ্রেশন’ বা সমাজে আত্মীকরণ করা বেশ জটিল। কারণ আশ্রয় আবেদন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি কাজে ফরাসি ভাষায় লিখতে ও পড়তে হয়। এছাড়া পরিবহন থেকে শুরু করে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং নির্মাণখাতে কাজ করতেও বিভিন্ন নির্দেশতা পড়তে হয়।”
সেনেগালিজ অভিবাসী আমিনাতা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ফ্রান্সে ‘শরণার্থী’ মর্যাদা পান। এই অভিবাসীকে তার বয়সের তুলনায় ১০ বছরের বেশি ছোট দেখায়। তিনি একটি বিউটিশিয়ান প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করেছিলেন। কারণ তিনি তার দেশে এই পেশায় ছিলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তিনি প্রশিক্ষণটিতে ভর্তি হতে পারেননি।
এই নারী অভিবাসীর মাতৃভাষা ফুলানি। তিনি সেনেগালের ফরাসি স্কুলে কয়েক বছর ধরে পড়াশোনা করলেও সেখানে লিখতে শেখেননি। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই সাবেক হেয়ারড্রেসার ফরাসি লিখতে ও পড়তে পারার জন্য নির্ধারিত এফএলই কোর্স শুরু করবেন।
তার আশা তিনি ফরাসি ডিপ্লোমা ডেলফ পাস করলে তার কাজ খুঁজে পেতে সহজ হবে।
অপর অভিবাসী সিবিও আশা করেন, পড়তে এবং লিখতে শেখা তার ফ্রান্সের জীবনকে আরও সহজ করে তুলবে। এই ২৮ বছর বয়সি মৌরিতানিয়ান নীল স্পোর্টস জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় সর্বদা সোনিঙ্কে ভাষায় ফোনে সঙ্গে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
ফরাসি ছিল তার কাছে বিদেশিদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ভাষা। তিনি কিছুদিন স্কুলে গেছিলেন। পরে তিনি স্বীকার করেন, “আমাকে সেখানে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছিল কারণ আমার পরিবারের জন্য খুব ব্যয়বহুল ছিল।”
২০১৮ সালে ফ্রান্সে আগমনের পর থেকে পড়তে এবং লিখতে পারার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি বুঝতে পারেন এই অভিবাসী। সিবি ফ্রান্সে আশ্রয় মর্যাদা পাননি। তবে তার আশা তিনি ফ্রান্সে একদিন নিয়মিত হবেন। বর্তমানে তিনি চাকরি খুঁজছেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু আপনি যদি পড়তে এবং লিখতে না পারেন তাহলে অনলাইনে চাকরি খোঁজা জটিল। যদি খুঁজেও পাওয়া যায় তাহলে কাজের চুক্তিটি বিস্তারিত পড়তে পারবেন না। এটি বুঝতে আপনাকে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
মন্তব্য করুন