যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত অভিবাসীদের সংখ্যা নির্ধারণ এবং করের বাইরে থাকা কর্মসংস্থানের উপর কর আরোপ করতে ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থাপনা চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির ৪০ জনেররও বেশি আইনপ্রণেতা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ৮ এপ্রিল জানিয়েছে, দেশটির অভিবাসন ব্যবস্থাপনার কিছু দিক পরিচালনা সহজ করতে সরকারের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন আইনপ্রণেতারা।
ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সংসদ সদস্যরা দাবি করেছেন, জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (এনএইচএস)-এর মতো অন্যান্য সরকারি পরিষেবায় যেভাবে ডিজিটাল আইডির প্রচলন আছে, সেভাবে যদি অনথিভুক্ত অভিবাসীদের জন্যও চালু করা যায় তাহলে করের বাইরে থাকা অবৈধ কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
কর বহির্ভুত বা অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বলতে বোঝানো হয়েছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ অর্থের মাধ্যমে যেসব কাজে কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়৷ এমন কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে নির্মাণ, আতিথেয়তা, কৃষি এবং গৃহস্থালি কাজ৷ এতে সরকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও মনে করেন সরকার দলীয় আইনপ্রণেতারা।
অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা যুক্তরাজ্যে বেশি
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত অনিয়মিত অভিবাসীদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করাটাকে বরাবরই কঠিন বলে মনে করা হয়৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরির এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত বসবাসের অনুমতি বা রেসিডেন্স পারমিট ছাড়াই দেশটিতে বসবাসরত অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা ছিল আট লাখ থেকে ১২ লাখ।
এই হিসাবে দেখা গেছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অনিয়মিত অভিবাসীরা বাস করছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩২টি দেশ এবং ইউরোপিয়ান ফ্রি টেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ)-এর সদস্য দেশগুলোতে বসবাসরত মোট অনিয়মিত অভিবাসীর ২৫ শতাংশ বাস করেন যুক্তরাজ্যে।
জার্মানির মতো বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে বিদেশি বা অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক বেশি৷ কারণ, অনিয়মিত পথে আশ্রয় চাইতে এসে অনেক মানুষ জার্মানিতে নিয়মিত হয়েছেন৷ উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জার্মানিতে অন্তত ১০ লাখ সিরীয় যুদ্ধ শরণার্থী রয়েছেন।
তরুণ অভিবাসী
মাইগ্রেশন অবজারভেটরি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের বসবাসরত অনিয়মিত অভিবাসীদের অন্তত অর্ধেক এসেছেন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে৷ আর ২০ শতাংশ এসেছেন সাব-সাহারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে।
ধারণা করা হয়, যুক্তরাজ্যে বববাসরত অনিয়মিত অভিবাসীদের মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান৷ তাদের মধ্যে অন্তত ৫৮ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বা এর নিচে৷ আর ১৮ বছরেরও কম বয়সি অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যাও প্রায় ১৪ শতাংশ।
অনিয়মিত অভিবাসীদের অন্তত ৩৬ শতাংশ ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করে আসছেন বলেও অনুমান করেছে মাইগ্রেশন অবজারভেটরি।
যুক্তরাজ্য অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে মাইগ্রেশন অবজারভেটরি৷ এগুলো হলো:
১. ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে এসে মেয়াদ পার হওয়ার পরও থেকে যাওয়া৷ আবার অনেকের বসবাসের অনুমতি বা রেসিডেন্স পারমিট থাকলেও ফৌজদারি অপরাধের দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তা বাতিল করা হয়েছে।
২. অনিয়মিত পথে বা জাল নথি দেখিয়ে যুক্তরাজ্যে আসা।
৩. আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়া এবং আপিলের সব অধিকার শেষ হওয়ার পরও যুক্তরাজ্য ছেড়ে না যাওয়া।
৪. যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অনিয়মিত অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তান৷ কারণ, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার দেশটির আইনে নেই।
নিয়মিত পথে এসেও অনিয়মিত অনেকে
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক অভিবাসী অধিকার বিষয়ক সংস্থা জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্র্যান্টস জানিয়েছে, দেশটিতে অনিয়মিত অভিবাসীদের একটি বড় অংশ নিয়মিত পথেই অর্থাৎ ভিসা নিয়ে দেশটিতে এসেছিলেন৷ কিন্তু পরে তারা অনিয়মিত হয়ে গেছেন৷
এমন অবস্থার জন্য শুধু অভিবাসন সম্পর্কিত সরকারি ফি পরিশোধে ব্যর্থতা এবং শর্তপূরণ করতে না পারাটাই মূল কারণ নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওইসব মানুষের জীবনের নানা বাঁকবদল৷
এদের মধ্যে অনেক নারী আছেন, যারা দেশটিতে এসেছিলেন তার ব্রিটিশ নাগরিক স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে৷ কিন্তু পরে আপত্তিকর সম্পর্কে বাধ্য করা, পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই সংসার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন অনেক নারী৷
জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্র্যান্টস বলছে, ‘‘এই অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাজ্য কিছুটা ভিন্ন৷ এখানে বেশ সাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনকারী মানুষের জন্যও নিয়মিত হওয়ার সুযোগ খুবই কম৷ এর অর্থ হলো, তাতে আরো বেশি মানুষ অনথিভুক্ত হচ্ছেন এবং সমাজে প্রান্তিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন৷’’
সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ‘‘বিপরীতে ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন এবং সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে যারা কাজ করছেন বা একটা অবস্থান তৈরি করেছেন এমন মানুষদের নিয়মিত হওয়ার জন্য সুযোগ দেয়া হচ্ছে৷’’
অনিয়মিত অভিবাসীদের আইনি সুযোগ না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব কম বেতনে কোনো শ্রম সুরক্ষা ছাড়াই চাকরি নিতে হয়৷ সেই চাকরিরও নেই কোনো নিশ্চয়তা৷ অনিয়মিত অভিবাসীদের যেসব কাজের সুযোগ পান, সেগুলোকে মূলত কম দক্ষতা এবং কম বেতনের কাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কাজ শারীরিক এবং পেশাগত ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে৷
কিন্তু ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা ডিজিটাল আইডি কার্ড প্রবর্তনের যে দাবি জানিয়েছেন, সরকার তা মেনে নিলে অনিয়মিত অভিবাসীদের কোনো উপকার হবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকেরা৷ তারা বলছেন, এতে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার মান বাড়বে না, বরং কর আরোপের একটি সুযোগ তৈরি হবে সরকারের জন্য৷
মন্তব্য করুন