বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যরাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াফিচারশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলার আকাশে আরব বসন্তের ছোঁয়া

রাকিব হাসান রাফি
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭

নিঃসন্দেহে ৩৬ শে জুলাই তথা ৫ আগস্ট ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রায় দেড় দশক ধরে টোটালিটারিয়ান কায়দায় দেশ পরিচালনা করে আসা শেখ হাসিনার সরকারের পতন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণার প্রতিশব্দ হিসাবে পরিগণিত হবে।

‘মুহাম্মদ বোয়াজিজি’ এ নামটির সঙ্গে আমরা অনেকে পরিচিত। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর আরবিভাষী মানুষের কাছে এক স্মরণীয় দিন। পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ফলবিক্রেতা মুহাম্মদ বোয়াজিজি সেদিন তিউনিশিয়ার সিদি বৌজিদ শহরের গভর্নর অফিসের সামনে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন। 

এ ঘটনা তিউনিশার সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। ফলে তারা সরকার পতনের দাবিতে দেশটির বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে জনরোষের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন প্রায় ২৫ বছর একনায়কতান্ত্রিক কায়দায় দেশ শাসন করা বেন আলীর সরকার। 

আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া রীতিমতো প্রায় অসম্ভব। এসব দেশের শাসন ব্যবস্থা কোনো এক নির্দিষ্ট পরিবার বা রাজবংশ অথবা কোনো এক স্বৈরাচারের হাতে পরিপূর্ণভাবে ন্যস্ত। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত ও ওমান ছাড়া আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শ্রেণি বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, শিক্ষিত হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজ এসব দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চরম ব্যাধি হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। তাই মুহাম্মদ বোয়াজিজির এ আত্মত্যাগ আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাধারণ নাগরিকদের মাঝে বিভিন্নভাবে আলোড়নের সৃষ্টি করে।

তিউনিশিয়ায় শুরু হওয়া সেই গণবিক্ষোভের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন আরব দেশে। ২০১০ সালের বিদায়লগ্নে শুরু হওয়া এ গণবিপ্লবের ঝড় যা ওই সময় আরব বিশ্বের বাতাসকে প্রকম্পিত করেছিল, ইতিহাসে ঠাঁই নেয় ‘আরব বসন্ত’ নামে। হিস্ট্রি ডটকমের তথ্য অনুযায়ী এ গণবিপ্লবে ছয় লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। 

দুর্ভাগ্যবশত যে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে আরব দেশগুলোর সাধারণ মানুষ ওই সময় গণবিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন তা আজও সে অর্থে পূরণ হয়নি। অথচ এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে ১৪টি বছর। আরব বসন্তের সুঁতিকাগার তিউনিশিয়ায় গণতন্ত্র এসেছে ঠিকই, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেনি খুব একটা। মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জয় পাওয়া মুরসির সরকার বেশি দিন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেনি। 

কারাগারে বন্দি অবস্থায় অত্যন্ত নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। হোসনি মুবারক ফিরে এসেছেন আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসির মধ্য দিয়ে। হোসনি মুবারকের চেয়ে আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুর এবং চরম কর্তৃত্ববাদী। লিবিয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে সে অর্থে কার্যকরি কোনো সরকার গড়ে উঠেনি। বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে পৃথক পৃথকভাবে দেশটির নিয়ন্ত্রণ। সিরিয়া ও ইয়েমেনে এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে। 

৩৬ শে জুলাইয়ের রক্তস্নাত বিপ্লবকে আরব বসন্তের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মুহাম্মদ বোয়াজিজি পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া মুহাম্মদ বোয়াজিজি। প্রায় পনেরো বছর ধরে বিএনপি থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। 
এমনকি ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতেও শিক্ষার্থীদের রাজপথ কাঁপাতে দেখেছি। 

তবে আবু সাইদের মৃত্যু এ দেশের পুরো রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয়। সাধারণ মানুষের মধ্যকার ক্রোধ ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হতে শুরু করে। জনসাধারণের প্রবল চাপে নতিস্বীকার করে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তাকে দেশ ছাড়তে হয়। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লির অদূরে অবস্থিত গাজিয়াবাদ শহরের একটি বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ মুহূর্তে একটি অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন। স্বাভাবিকভাবে বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী একটি দেশে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। আমাদের দেশেও তেমনটি হয়েছে। নতুন সরকারকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগোতে হচ্ছে। তবে বিগত কয়েক দিনে আমার দৃষ্টিতে বেশ কিছু বিষয় সামনে এসেছে। আমি এক অর্থে এসব বিষয়কে ঘিরে হতাশ। ৩৬ শে জুলাইয়ের রক্তস্নাত বিপ্লব কি আরব বসন্তের পরিণতি বরণ করবে কি না সেটা নিয়ে আমি বেশ শঙ্কিত। 

বিশ্বের প্রায় সবদেশে বিপ্লব বা নবজাগরণের পর জনসাধারণের কথা বিবেচনা করে নতুন করে সংবিধান রচনা করা হয়। গত সাড়ে পনেরো বছর যে সাংবিধানিক ফ্রেমের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ পরিচালনা করেছেন তাকে ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, ‘এ সংবিধান একনায়কতান্ত্রিক শাসন পোখত করার অন্যতম একটি হাতিয়ার’।

সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় উল্লেখ করার মতো অসংগতি রয়েছে। তাই সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে বা নতুন সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ সে অর্থে চোখে পড়ছে না। এছাড়াও বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ঘিরে বিভিন্ন সমালোচনা রয়েছে। সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখা হবে কি না সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের থেকে একটি সুস্পষ্ট উত্তর আসা প্রয়োজন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস চাইলে তিন মাসের মধ্যে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করতে পারেন। 

যদি এ দেশের সিংহভাগ মানুষের রায় তার পক্ষে আসে তাহলে তিনি এ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারবেন এবং সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে সংবিধান রচনার জন্য কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে পারবেন। তাই আমার দৃষ্টিতে এ মুহূর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম দায়িত্ব হবে দ্রুত হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করা এবং সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে সংবিধান রচনার জন্য উদ্যোগ নিতে পারবেন। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদি এক্ষেত্রে সমর্থ না হন, তাহলে তাকে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কাজ করতে হবে যেন জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দল এদেশের ক্ষমতায় আসতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের ফরম্যাট কি রকম হবে সেটা নিয়ে একটি রূপরেখা দাঁড় করানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে কেননা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া দেশ পরিচালনা করা অনেক সময় জটিল হয়ে পড়ে।  

মিশরে মুরসির সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির একটি প্রধান কারণ ছিল প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা। হোসনি মুবারকের শাসনামলে বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে মুরসির প্রশাসনে থেকে গিয়েছিলেন। তারা মুরসির সরকারকে অস্থিতীশীল করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। একইভাবে, সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সুবিধাপ্রাপ্ত অনেক সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সচিব এবং পুলিশ সদস্য এখনও তাদের স্বপদে বহাল আছেন।

এমনকি অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ হয়ে গিয়েছেন। ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা অনেক ব্যক্তিত্বও এ সরকারে ঠাঁই পেয়েছেন। এ কারণে এ সরকারে যেসব বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্ত প্রতিবেদনে যদি স্পর্শকাতর বিষয় উঠে আসে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তবে আমরা দেখছি যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছেন। আমি এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না। এভাবে ঢালাও পদত্যাগ পরবর্তীতে প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। 

কারও বিরদ্ধে যদি কোনো ধরনের গুরুতর অভিযোগ থাকে, তাহলে সবার প্রথমে উচিত একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের অধীনে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা। তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত তাকে কোনোভাবে পদত্যাগ করতে দেওয়া উচিত নয়। একই সঙ্গে যারা এ মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তারা যেন কোনোভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হন সেটা নিশ্চিত করা এ সরকারের দায়িত্ব। 

এছাড়াও আমরা দেখছি, বিগত সাড়ে পনেরো বছরে প্রশাসনে চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের অনেকে নতুন করে পদোন্নতি নিচ্ছেন বা চাকরিতে প্রত্যাবর্তন করছেন। আমার মনে হয়, ঢালাওভাবে পদোন্নতি বা চাকরিতে পুনরায় নিয়োগের পরিবর্তে একটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে তাদের পদোন্নতি বা চাকরিতে পুনরায় নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। অন্যথায় প্রশাসনে নতুন করে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। 

বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও হেফাজতে ইসলাম থেকে শুরু করে এ মুহূর্তে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা যেন সুষ্ঠুভাবে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিগত সাড়ে পনেরো বছর শেখ হাসিনার সরকারের দমন-পীড়ন নীতির ফলে দেশের বিরোধী দলগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। 

সাংগঠনিকভাবে এসব রাজনৈতিক দল ভেঙে পড়েছে। একটি লম্বা সময় এসব বিরোধী দল সে অর্থে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। তৃণমূল পর্যায়ে যারা এসব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট বা চাঁদাবাজির ঘটনা লক্ষ্য করেছি।

অনেকে এজন্য বিএনপি ও জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী বা সমর্থককে দায়ী করছেন। এটা ঠিক যে গত সাড়ে পনেরো বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা বিভিন্নবভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে কোনো কিছু বিবেচনা না করে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। তাই এসব রাজনৈতিক দল যেন নিজেদের মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে সেজন্য তাদের সুষ্ঠুভাবে রাজনীতি চর্চার সুযোগ দিতে হবে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাম্প্রতিক কিছু কার্যকলাপ আমাকে হতাশ করেছে। শুরু থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দাবি করে আসছিলো যে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু বর্তমানে এ সংগঠনের অনেক সমন্বয়ককে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুনছি যা কোনোভাবে কাম্য নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির একটি বক্তব্য ‘স্বৈরাচার হটাইতে পারছি, সাংবাদিকদের ১৫ সেকেন্ডেই ফিনিশ করে দেবো’- আমার মাঝে রীতিমতো উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। 

আমার বারবার মনে হয়েছে, এক স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে আমরা আরেক ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় আনতে যাচ্ছি না তো? আমার মনে হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব ধরনের কার্যক্রম এ মুহূর্তে স্থগিত করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উচিত এখন পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা। পড়াশোনা শেষ করার পর তারা যদি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারে। তাদের অনেকের মাঝে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। এখন তাদের উচিত নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করা। সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা বা বাজার মনিটরিং করা তাদের কাজ নয়। 

ভবিষ্যতে আমাদের দেশ যদি আবার অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয়, তখন তারা মাঠে নেমে কাজ করতে পারে। অথবা সরকারের পাশে থেকে সহায়ক শক্তি হিসেবে তারা কাজ করতে পারে। এ মুহূর্তে তারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসুক এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দুই তরুণ শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগেনি। কেননা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিচালনা করার কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এ বয়সের কারও হাতে ন্যস্ত করা উচিত নয়। 

সানা মেরিন যখন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। জেসিন্ডা আরডার্নও তরুণ বয়সে নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিমের দেশগুলোতে আইনের শাসন আছে এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আছে। এসব দেশ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। পশ্চিমা যে কোনও দেশের তুলনায় বাংলাদেশ শাসন করা অনেক বেশি দুরূহ। 

আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বুঝতে হবে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনে এ দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সমান ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সবার সাড়ে পনেরো বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলাফল ৩৬ শে জুলাই। দুর্ভাগ্যবশত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ এ অর্জনের পেছনে নিজেদের অংশগ্রহণকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরছেন। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের লড়াই বা সাধারণ মানুষের অবদানকে তারা সেভাবে মূল্যায়ন করছেন না। 

আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল। হিটলারের পতনের জার্মানিতে নাৎসি পার্টির সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছেন কিন্তু সেটা কোনোভাবে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশে তার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। 

দেশের একটা অংশের মানুষের মাঝে আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকবে এটা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এদেশের জনগণ। যদি কোনো সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায়, সেক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মতামত জরুরি। আর যতদিন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত যদি তারা শান্তিপূর্ণভাবে এদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে চায় সে সুযোগ তাদের দেওয়া উচিত। 

কাদের সিদ্দিকীর গাড়িতে হামলার বিষয়টি কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা হয় এবং নতুনভাবে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা যদি আওয়ামী লীগকে সাজাতে চায়, তাহলে তাদের সে সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে এই আওয়ামী লীগ হতে হবে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের প্রভাবমুক্ত।

বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব সব সময় থাকবে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী। উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম এমনকি দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ রয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এক দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ভারতের অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল সুপারপাওয়ার। সামরিক দিক থেকে যেমনভাবে দেশটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। 

বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত ও তুরস্ক এখন দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ভারতকে আমরা কোনোভাবে ফেলে দিতে পারবো না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং ভারত একটি বৃহৎ রাষ্ট্র তাই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে অসামঞ্জস্যতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে হবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পর্ক যেমনটি হয় তেমন। 

সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য ভারত আমাদের দেশের মুখাপেক্ষী। ভারতের নীতি-নির্ধারকদের বাংলাদেশ তো বটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে সাজাতে হবে। ভারতকে বুঝতে হবে যে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্পর্ক হবে জনগণের ওপর ভিত্তি করে, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের দিকে তাকিয়ে নয়। ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে তাদের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করেন যা দুর্ভাগ্যজনক। ভারত গ্লোবাল সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং ভারতের মাঝে সে সম্ভাবনা প্রবল। ভারতকে বুঝতে হবে, প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে ভারত কোনো দিন এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। 

ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য দুই দেশের নীতি-নির্ধারকদের এখন থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতে আকাশ ব্যানার্জী, ধ্রুব রাঠি, মনীষা পাণ্ডে, রাভিশ কুমার বা অভিনন্দন শেখরির মতো অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার রয়েছেন যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রে। বাংলাদেশ চাইলে তাদের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে পারে যেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সত্যিকার অর্থে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন করা যায়। 

একই সঙ্গে রিপাবলিক বাংলা থেকে শুরু করে ভারতের কিছু মিডিয়ায় অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে, সেটা নিয়েও এ দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের আরও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারকে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে তুলে ধরতে হবে। ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ দাবি করছেন যে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে সনাতন ধর্মালম্বী মানুষদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেছে! 

তাদের এ বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করার জন্য সরকার প্রয়োজনবোধে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাতে পারে। ভারত যদি বাংলাদেশের জনগণের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে না পারে এবং এ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ থেকে সরে আসার চেষ্টা না করে, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য সুখকর ফল বয়ে আনবে না। একইভাবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হলে সেটাও আমাদের জন্য নেতিবাচক ফলাফল সৃষ্টি করবে। 

হাজারো মায়ের বুকের আর্তনাদ, অসংখ্য মানুষের বুকের তাজা রক্ত ও এ দেশের আপামর জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। অনেকের দৃষ্টিতে ৩৬ শে জুলাই বা পাঁচ আগস্ট হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। এ স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলা বর্ষিকপঞ্জিতে এখন শ্রাবণ মাস। শ্রাবণের এ বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো এদেশে আবির্ভূত হয়েছে এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ যেনও আরব বসন্তের মতো একই পরিণতি বরণ না করে সে দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। 

প্রফেসর ড. ইউনূসকে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো শক্ত হতে হবে। তার সরকারকে আরও দ্রুততার সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। সামনের বাংলাদেশ হোক একটি সুন্দর বাংলাদেশ যেখানে এ দেশের সকল নাগরিকের স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটবে। 

রাকিব হাসান রাফি,
শিক্ষার্থী,
ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া।

মন্তব্য করুন