অবৈধপথে বিপজ্জনকভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিযাত্রায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিপজ্জনক রুটে ইতালিতে পৌঁছানো বাংলাদেশিদের সংখ্যা বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য ওঠে আসে।
তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২,৫৮৯ জন বাংলাদেশি ইতালির উপকূলে পৌঁছেছেন। গত বছর এই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১,২০৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে সমুদ্রপথে যারা ইতালি গেছেন তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশই বাংলাদেশি।
গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৮৫ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬২১ জন বাংলাদেশি ইতালি গিয়েছিলেন।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে অবৈধ উপায়ে ইউরোপযাত্রা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা সতর্ক করে বলেছেন, ঝুঁকি নিয়ে এভাবে মানুষের বিদেশে যাওয়ায় বোঝা যায় দেশে গভীর আর্থ-সামাজিক সমস্যা রয়েছে।
১৭ এপ্রিল ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত ইতালি সি অ্যারাইভালস ড্যাশবোর্ডের ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য অনুসারে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইতালি যাচ্ছেন তারা সবাই লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে।
আর উত্তর আফ্রিকায় একটি শক্তিশালী মানব পাচারকারী চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরেই লিবিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
ইউরোপের উদ্দেশে এই বিপজ্জনক যাত্রা শুরু হয় লিবিয়া যাওয়ার মাধ্যমে। এরপর শুরু হয় আন্তরাষ্ট্রীয় পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রযাত্রা। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মাথাপিছু পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এই টাকা জোগাড় করতে অনেকেই উচ্চ সুদে ঋণ নেন, এমনকি জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়।
আসিফ মুনীর আরও বলেন, অনেকেই এই ভেবে ঝুঁকি নেন যে, একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলে অস্থায়ীভাবে হলেও বসবাসের সুযোগ পাওয়া যাবে এবং তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে না। কারণ অভিবাসীবান্ধব দেশ হিসেবে মনে করা হয় ইতালিকে।'
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, 'দালালরা এখন লোক সংগ্রহ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করছে। ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতি পেয়ে দেশ ছাড়ার পর শেষ পর্যন্ত তারা লিবিয়ায় মাসের পর মাস, কখনো কখনো বছর ধরে আটকা পড়ে থাকেন।'
সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়াও ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌকা, ইঞ্জিনের ত্রুটি এবং জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের অভাব প্রায়শই নৌকাডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। যদিও এ বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে কোনো বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি, তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো আশঙ্কা করছে যে ঝুঁকি এখনো অনেক বেশি।
উল্লেখ্য, এই অভিবাসন প্রত্যাশীদরর প্রায় ৯৩ শতাংশই লিবিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকা পড়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ জীবন হারায়, আবার কেউ কেউ জিম্মিদশা থেকে বের হতে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এবং ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে যাওয়ার প্রতি এক ধরনের মোহ বা 'মাইগ্রেশন কালচার' তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, মাদারীপুর, সিলেট এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর অধিবাসীদের ঝুঁকি নেওয়ার এই প্রবণতা বেশি। তিনি আরও বলেন, 'লিবিয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জেনেও শুধুমাত্র ইতালি পৌঁছানোর আশায় অনেকেই এই পথে পা বাড়ায়।'
মন্তব্য করুন