বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মেহেদীর বাবা-মার স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবা-মায়ের মুখ উজ্জল করবে। সেই স্বপ্ন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর গুলিতে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আর তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা এখন পিতা মাতা। পরিবারের একমাত্র নাতীর জন্য কাদঁতে কাদঁতে নানীর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস পরও নানী অপেক্ষায় থাকেন কখন আসবে নাতী, ডাকবে নানী বলে।
নিম্নবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিল মো. মেহেদী (২০)। বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা জীবন থেকেই জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে আসেন মেহেদী। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পিচঢালা রাস্তায় রক্ত ছড়িয়ে চলে যান পরপারে। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবা মার মুখ উজ্জল করতে না পারলেও গর্বিত করেছেন পরিবার আর এলাকাবাসীকে।
শহিদ মেহেদীর বাড়ীতে পরিবারের সদস্যদের সাথে বাসস সংবাদদাতার কথা হয়। তার পিতা মো. সানাউল্লাহ (৫২) বাসস’কে জানান, এক পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মেহেদী ছিলেন ছোট। বড় বোন নির্জনাকে বিয়ে দিয়েছেন।
নিজে বসুন্ধরা গ্রুপের পেপার মিলে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। পৈত্রিক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার রায়পাড়া গ্রামে। থাকেন নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউচর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে।
জন্মের পর থেকে মেহেদী নানীর বাড়িতে বড় হন।স্থানীয় গজারিয়া প্রাইভেট ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সোনারগাঁও শিল্পনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি।
শোকে কাতর মেহেদীর মা শিল্পি বেগম (৪৫) বলেন, ‘গত ২০ জুলাই দুপুরে মেহেদী খেতে আসবে বলে চলে যায়। সবার সাথে আন্দোলন করতে গিয়ে আদরের একমাত্র ছেলে লাশ হয়ে আসলো। পুলিশের গুলিতে আমার বাবার মাথার মগজ পর্যন্ত বের হয়ে গেছে।
চুরমার হয়ে গেল আমাদের স্বপ্ন। কি দোষ করেছিল মেহেদী? কেন ওকে গুলি করে মারলো? যারা আমার সন্তানকে মেরেছে তাদের বিচার করতে হবে। আমি তাদের বিচার চাই।’
শহিদ মেহেদীর পিতা বলেন, ‘বিকাল ৫টায় নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে ডাচ বাংলা ব্যাংকের পেছনে হিরাঝিল আবাসিক এলাকায় রাস্তায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় মেহেদি। গুলিতে মাথার মগজ পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭ টায় মেহেদীর মোবাইল থেকে অপরিচিত একজন বলে আপনার সন্তান চিটাগাং রোডে গুলি খেয়েছে।
আমি নারায়ণগঞ্জে চিটাগাং রোডে গিয়ে দেখি আমার একমাত্র সন্তান রাস্তার ওপর পড়ে আছে।মাথায় গুলি লাগায় মগজ পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। এলাকার লোকজন পলিথিন দিয়ে সন্তানকে ঢেকে রেখেছিল। পুলিশ শুধু গুলিই করেনি, মৃত সন্তানের শরীরেও লাথি মারে। ঐদিন রাতেই সন্তানের লাশ ঝাউচরে নিয়ে আসি এবং জানাজা শেষে স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে দাফন করি।’
ঝাউচরে মেহেদীর ঘরে টেবিলের ওপর বইগুলো সুন্দর ভাবে সাজানো আছে। বইগুলো দেখে, আর মা চোখের পানি মোছে। মেহেদীর কথা বলতেই নানি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
চোখের পানি মুছতে মুছতে এ সংবাদদাতাকে বলেন, আদরের নাতী ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান।এক ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের ঘরের একমাত্র পুত্র সন্তান ছিল মেহেদী। ছোট কাল থেকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি।যারা আমার নাতীকে খুন করেছে আল্লাহ যেন তাদের বিচার করে।
বড় বোন নির্জনা বলেন, ‘ছোট ভাই ছিল আমাদের পরিবারের সবার আদরের।পড়াশুনায় ভালো ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে ছিল। তাই অভাব অনটনের সংসারেও বাবা ভাইকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জিষ্টে ভর্তি করায়। টিউশনি করে পড়া লেখার খরচ চালাতো সে। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পরিবারের মুখ উজ্জল করতে চেয়েছিল। আন্দোলনে গিয়ে জীবন দিয়ে আমাদের এখন অন্ধকারে ফেলে চলে গেল।’
ঝাউচরের মেহেদীর বন্ধু কামাল বলেন, লেখাপড়ার পাশপাশি সে ভালো ছবি আঁকতো।আমরা এলাকায় একসাথে খেলতাম। সবার সাথে ভালো সর্ম্পক ছিল মেহেদীর।
শহিদ মেহেদীর পিতা বাসসকে বলেন, ছেলেকে হারিয়েছি। আর কোন দিন ফিরে পাবো না। রাষ্ট্র যাতে এদের ভুলে না যায়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয় এ দাবি করি।
মেহেদীর পিতা জানান, তারাজুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা এবং মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
মন্তব্য করুন