বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১
জাতীয়প্রবাস বাংলাঅপরাধবাণিজ্যরাজনীতিসারাদেশমতামতস্বাস্থ্যফিচাররাজধানীপাঠকের কথাআবহাওয়াশিল্প-সাহিত্যগণমাধ্যমকৃষি ও প্রকৃতিইসলামবৌদ্ধহিন্দুখ্রিস্টানআইন-বিচারবিবিধআপন আলোয় উদ্ভাসিতবেসরকারি চাকুরিসরকারি চাকুরি Photo Video Archive

বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১

ডিম বিক্রেতা কোহিনুরের এ কেমন জীবন যুদ্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৫৪
ছবি-সংগৃহীত

রাত শেষে ভোরে ঘুম ভাঙে নানা স্বপ্ন বুকে নিয়ে। তেমনি একজন কোহিনূর বেগম। তিনি জীবনের স্বপ্ন নিয়ে শহরের ফৌজদারি মোড়ের ফুটপাতে দেশীয় মুরগি, হাঁস, কোয়েল পাখির ডিম ও কলার পসরা নিয়ে বসেন।

কোহিনুর বেগমের বাড়ি জমালপুর পৌরসভার দেওয়ানপাড়া এলাকায়। জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই ভোর পাঁচটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ফুটপাতে দেশী হাঁস-মুরগির ডিম, কোয়েল পাখির ডিম ও কলা বিক্রি করে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন।

এরইমধ্যেই তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগে। ডাক্তার বলেছেন হার্ট ছিদ্র হয়ে গেছে। রিং বসাতে বলেছেন- কিন্তু টাকার অভাবে আজো সেটি বসানো সম্ভব হয়নি। কোহিনুরেরও ইচ্ছা নেই। কারণ তার কাছে টাকা নেই। এরপরও ছেলে-মেয়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে নিত্যদিন ভোর ফুটপাতে দেশীজাতের মুরগী ও হাঁসের ডিমসহ কলার পসরা সাজিয়ে বসেন।

জামালপুর শহরের ফৌজদারি মোড়ের বাজারটি মূলত সকাল বেলাতে বসে। এ বাজার থেকে জামালপুর শহরের অনেকেই ঘুম থেকে উঠে হাটতে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসেন। এতে রথ দেখাও হলো- আবার কলা বেচাও হলো। এ সুযোগটি কোহিনুর বেগমও ছাড়তে নারাজ। তিনিও ফুটপাতে হাঁস ও দেশি মুরগির ডিমের পাশাপাশি কোয়েল পাখির ডিম ও কলার দোকান নিয়ে বসেন। বেচা কেনাও ভালো। তবে সকালেই তার বেশি বেচা হয়।

কোহিনুর বলেন, আগে ফৌজদারি মোড়ে তার চা  দোকান ছিলো। কিন্তু শরীর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ভারী কাজসহ আগুনের তাপে থাকতে পারেন না। ডাক্তারও নিষেধ করেছেন। তাই চা বিক্রির ব্যবসা বাদ দিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেছেন।

কী অসুখ হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার কইছে হার্ট ছিদ্র হইয়া গেছে। হার্টে রিং বসাতে হবে। কোনো কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না। শরীর খুব দুর্বল লাগে। বুকের ভিতরে কুটকুট কইরা কামড়ায়। শুধু সংসার ও ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্রভাবে কিছু মাল নিয়ে ফুটপাতে বসে বিক্রি করে যা কামাই হয়- তাই দিয়েই সংসার চলে। 

স্বামী নেশা করে। আর আমারে গালিগালাজ করে। সংসারে দুই ছেলে এক মেয়ের সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে বড় ছেলে বিয়ে করে বউকে নিয়ে আলাদা হইয়া গেছে। আমাদের দেখে না, খোঁজখবরও নেয় না এবং সম্পর্কও খুব একটা ভাল না বড় ছেলের সাথে। তাই বাধ্য হয়েই দোকান করতে হয়।

দরিদ্র কোহিনুরের কোনো পুঁজি নেই। তার ক্ষুদ্র এ দোকানে আট থেকে দশ হাজার টাকার মালামাল রয়েছে। সে মালামালগুলো জামালপুর শহরের এক মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে নিয়ে আসে। সারাদিন যা বেচা-কেনা হয় তাতে লাভের অংশ রেখে বাকি টাকা মহাজনকে দিয়ে আবারো নতুন করে মাল নিয়ে আসে।

কোহিনুর বলেন, সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হাঁসের ডিম, দেশি মুরগির ডিম ও কলা বিক্রি করে ৪শ থেকে ৫শ টাকা কামাই হয়। শহরে দেশি ডিম ও কলার খুব চাহিদা রয়েছে। তাই এগুলোই তিনি পণ্য হিসেবে বেঁচেন। দেশীয় পণ্য বিক্রির জন্য তার খ্যাতি রয়েছে এমনটাও জানান তিরি। হাঁস বা দেশি মুরগির ডিমের জন্য মানুষজন তার কাছেই ছুটে আসে।

অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো সকালে কেন আসেন জানতে চাইলে কোহিনুর বলেন, ভোরে না আসলে জায়গাটি তার দখলে নেয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া ফৌজদারি মোড়ের এ বাজারটি খুব সকালে বসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষুদ্র কৃষক বা ব্যবসায়ীরা তাদের নিত্যপণ্য বেচা-কেনার জন্য হাজির হয় এই বাজারে। সকাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে বাজার শেষ হয়ে যায়।

তারপরেও কোহিনূর বেগম রাত ১২টা পর্যন্ত তার পণ্য নিয়ে বসে থাকে বিক্রির আশায়। সকালে বিক্রি ভাল হলেও দুপুরে বিক্রির পরিমাণ কমে আসে। এ সময় একটু বিশ্রামের জন্য বাসাতে যেতে আগ্রহী নন তিনি। কারণ হিসেবে বলেন, বাসায় অশান্তি গিয়ে লাভ কী। ফুটপাতেই ভালো থাকি। কিছু বিক্রিও হয়। মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে মনটা হালকা হয়। শুধু সংসার আর ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে অসুস্থ শরীর নিয়ে এ ব্যবসা রয়েছি। এ ব্যবসা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।

এদিকে ক্ষুদ্র এ ব্যবসা করে কোহিনুর তার সংসার চালানোর পাশাপাশি এনজিও থেকে নেয়া ৪০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করে আসছেন। প্রতিদিন কিস্তি দিতে হয়। আর কয়েকটা কিস্তি দিলেই ঋণ শেষ হইয়া যাইবো। শেষ হওয়ার পরে আবার ঋণ নিবেন বলেন জানান তিনি।

কোহিনূর বেগমকে ডাক্তার হার্টে রিং পরাতে টাকা লাগবে তিন লাখ। তিনি বলেন, এত টাকা পাবো কোথায়? রাত বারটা পর্যন্ত বিক্রি করে যা কামাই হয় তাই দিয়ে তো সংসারই চলে না। তার মধ্যে আবার প্রতিদিন এনজিও'র কিস্তি দিতে হয়। শরীরডা ভালো থাকলে আর চিন্তা করতাম না। কত পরিশ্রম করছি আমি। একসময় স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় থাকতাম গার্মেন্টসে চাকরিও করছি। এখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না।

ভরদুপুরে কলা খেতে আসা যুবক সুমন মাহমুদ বলেন, মানুষ বাঁচে আশায়- কিন্তু যার আশাই নেই তার বেঁচে থেকে লাভ কী? এরপরেও বেঁচে থাকতে হয় পরিবার পরিজনদের কথা ভেবে। এরই জলন্ত উদাহরণ কোহিনূর বেগম। তিনি নিজের কথা চিন্তা না করে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে জীবনের শেষ সময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

দেশী মুরগির ডিম ক্রেতা সোহাগ রানা বলেন, আমার প্রতিদিন সকাল ও রাতে ডিমের বিশেষ প্রয়োজন হয়। সব জায়গায় দেশীয় ডিম পাওয়া যায় না। অনেক দোকানদার ছোট সাইজের ফার্মের ডিম দিয়ে বলে দেশি মুরগির ডিম। তাই প্রতারণার কবল থেকে রক্ষা পেতে কোহিনুর আপার কাছে থেকেই ডিম নিয়ে যাই।

দুদক জামালপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, কোহিনুর বেগমের চিন্তা-চেতনা-মাতৃত্ববোধ একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। জীবনে পাহাড়সম দুঃখ কষ্ট নিয়ে শেষ প্রান্তে এসে আজো ছেলেমেয়ের জন্য ফুটপাতে দোকান করছে। ভাগ্যে জুটছে না সুচিকিৎসা। আসুন এমন মাকে আমরা সেলুট জানাই। এই জীবন সংসারে কোহিনুরা মরে না বেঁচে থাকে মানুষের মাঝে উদাহরণ হয়ে।

মন্তব্য করুন