বগুড়ার ভদ্রাবতী নদীটি আগে থেকেই দর্শনীয়, তারপর আবার বর্ষাকালে হয়ে উঠে নবযৌবনা। এই নদী দেখতে কিছুটা সিলেটের রাতারগুলের মতো; সেজন্য লোকে বলে মিনি রাতারগুল। আবার কেউ কেউ বলে মিনি কক্সবাজার।
যে যাই বলুক; এই মিনি রাতারগুল দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শকরা ছুটে আসছেন। শুক্রবার ও শনিবার সবচেয়ে বেশি ভিড় করছেন তারা। দর্শকদের আনাগোনায় আশেপাশে বসেছে দোকানপাট এবং নদীর ঘাটে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ছোট বড় নৌকা।
মিনি রাতারগুল বগুড়া শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার বুড়ইল ইউনিয়নের মুরাদপুর বাজার এলাকায়। এই বাজারে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি কালভার্ট। এর নিচ দিয়ে প্রবাহিত ভদ্রাবতী নদী। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে ভরা যৌবনা হয়ে প্রবাহিত হয়।
কালভার্ট থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে গেলে ঝলমলে পানিতে নৌকা বাইতে আসা ভ্রমণ পিপাসু একাধিক দলের দেখা মিলবে। এছাড়াও দূর-দুরান্ত থেকে আগত দর্শকদের নদীতে ভ্রমণের জন্য থাকবে নানা রঙের ভাড়াকৃত নৌকা। যার যতক্ষণ ইচ্ছা সে ততক্ষণ নৌকা ভ্রমণ করতে পারবে।
মিনি রাতারগুল ভদ্রাবতী নদীটি নন্দীগ্রাম উপজেলা সদর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে বুড়ইল ইউনিয়নের মুরাদপুর গ্রামের শেষপ্রান্তে রয়েছে। বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার শাবরুল বিল থেকে উৎপত্তি এ নদীর। এই নদীর সঙ্গে সিংড়ার চলনবিল ও যমুনা নদীর সংযোগ রয়েছে।
ভদ্রাবতী নদী এবং এর চারপাশের পরিবেশ কিছুটা সিলেটের রাতারগুলের মতো হওয়ায় প্রথমে ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচার হয়ে নাম করা হয়েছে বগুড়ার মিনি রাতারগুল। সেই ফেসবুক-ইউটিউব দেখে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জেলার দর্শকরা ভ্রমণ করতে আসছেন ভদ্রাবর্তী নদীতে।
মুরাদপুরের লোকজন জানিয়েছেন, তারা দাদার মুখে শুনেছেন রাজার শাসনামলে শাবরুল দিঘীর বুক চিরে ভদ্রানদীর আবির্ভাব ঘটেছিল। সেন বংশের অচ্যিন কুমার নামে শেষ রাজার আমলে তার কন্যা ভদ্রাবতীর নামানুসারে নদীর নামকরণ। সেই সময়ে পানিতে নদী থৈথৈ করত।
সময়ের বিবর্তনে চারপাশের মাটি ও আর্বজনা পড়ে নদীটি ভরে গেছে। খরা মৌসুমে ভদ্রাবতীতে পানি থাকে না। তবে ভরা বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি টলমল করে।
বগুড়া শহর থেকে মিনি রাতারগুলে আগত শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুনা পারভীন জানান, ছুটি এবং ব্যস্ততার কারণে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায় না। এই ভদ্রাবতী নদী রাতারগুলের মতো অনেকের মুখে শুনেছি। তাই আমরা সিনিয়র-জুনিয়র সহকর্মীরা শুক্রবারের ছুটি থাকায় রাতারগুল দেখার জন্য এসেছি। এখানে ঘুরে অনেক ভালো লেগেছে।
পাবনা থেকে আগত মমিনুল হক জানান, ফেসবুক-ইউটিউবে দেখে আমি এখানে এসেছি। ভদ্রাবতী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। এই নদীতে নৌকা চলছে, আরো খানিকটা দূরে গিয়ে দেখা যায় এখানকার গ্রামের বাসিন্দারা কেউ মাছ ধরছেন, আবার কেউ ঝলমলে পানিতে ঝুপ করে গোসল করতে নেমেছেন। দুই ধারে গাছপালা, তার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ভরা যৌবনা ভদ্রাবতী নদী।
ঢাকার সাভার থেকে আগত মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানান, এই রাতারগুল আগে ফেসবুকে দেখেছি। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। খুবই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এখানকার রাতারগুলে। কোলাহলহীন শান্ত-স্নিগ্ধ ভদ্রাবতী ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করে চলে। ভদ্রাবতী নদীর দুই ধারের গাছগুলো বেশ ডালপালা ছড়িয়ে আছে। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে নদীতে ঘুরে মনে হচ্ছে এ যেন সিলেটের রাতারগুল।
নাটোর থেকে আগত ব্যবসায়ী রাকিব উদ্দিন কমল জানান, বগুড়ার রাতারগুল সুন্দর সবুজ মনোরম পরিবেশে যেন সেজেছে তার অলৌকিক রূপে। ভদ্রাবতী নদীতে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করলাম। নৌকার তলায় ঢেউয়ের শব্দে অন্য রকম এক পরিবেশ। এখানকার নীরব প্রকৃতি আর মৃদুমন্দ বাতাসে এরই মধ্যে নিস্তব্ধতা ভাঙে গাছে বসে থাকা পাখির ডাকে, হঠাৎ ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় একঝাঁক পাখি। সবকিছু মিলিয়ে চমৎকার লেগেছে।
মুরাদপুর বাজারে গাড়ি পার্কিং গ্যারেজ মালিক খলিলুর রহমান জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ মিনি রাতারগুল খ্যাত ভদ্রাবতী নদী দেখতে আসছে। যত দিন যাচ্ছে দর্শকদের উপস্থিতি বাড়ছে। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবার সবচেয়ে বেশি দর্শকদের সমাগম ঘটে।
ভদ্রাবতী নদীর নৌকার মাঝি মোমিন মিয়া জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শকরা এই নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকা ভ্রমণ করেন। কখনো নৌকা রিজার্ভ, আবার কখনো মানুষের সংখ্যা ভেদে নিদিষ্ট সময় বেঁধে ভাড়া নেয়া হয়। বর্ষা মৌসুমেই নৌকা চলে। শুক্রবার ও শনিবার বিকেলে দর্শকদের প্রচণ্ড ভিড় জমে।
নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, দুই বছর আগে এই উপজেলায় যোগদান করার পর অনেকের মুখে শুনতাম এখানে রাতারগুল আছে। সেটা হলো মুরাদপুর ভদ্রাবতী নদী। এক শুক্রবার পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে যাই। সেই ভদ্রাবতী নদী এবং পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করবে। নন্দীগ্রামের ভদ্রাবতী নদীর প্রাকৃতিক নিরব পরিবেশ খুবই মনোমুগ্ধকর। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে খবর পাই, সেখানে বিভিন্ন জেলার দর্শকরা ভিড় করে এবং আশেপাশে বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এতে ওই এলাকার মানুষ আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।
সরকারি পৃষ্টপোষকতায় ভদ্রাবতী খননের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ও একটি সুইচ গেট স্থাপন করার দাবি জানান এলাকাবাসী।
মন্তব্য করুন