বাগানের প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় সবুজ মাল্টা ঝুলে আছে। বেশিরভাগ গাছে এক থেকে দেড় মন মাল্টা আসায় নুয়ে পড়ছে গাছগুলো। বিক্রির উদ্দেশ্যে শ্রমিকরা মাল্টা তোলার কাজ করছেন।
বাগান ঘুরে দেখাসহ শ্রমিকদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বাগান মালিক কাজিম উদ্দিন। স্থানীয় লোকজন বাগান দেখতে আসায় বিনামূল্যে মাল্টা খেতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অনেকে বাগান থেকে কেজি দরে মাল্টা কিনে নিচ্ছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটি ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর গ্রামের বাবুগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক কাজিম উদ্দিনের মাল্টা বাগানের চিত্র এটি। ২০১৯ সালে হার্টে পাঁচটি ব্লক ধরা পড়ে স্কুলশিক্ষক কাজিম উদ্দিনের। ঢাকায় এসে রিং পরান তিনটি।
যে চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তিনি পরামর্শ দেন গাছ-গাছালি প্রকৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। নিজের বেশকিছু জমিও ছিল। ঝোঁক হলো বাগান করার। নিজের ৬৫ শতক জমিতে ২০০টি ভিয়েতনামী সবুজ মাল্টা বা বাউ- থ্রি মাল্টার চারা লাগিয়ে বাগান গড়ে তুলেন। এতেই কম খরচে অধিক লাভের মুখ দেখতে থাকেন তিনি। প্রথমে অল্প জমিতে মাল্টা চাষ শুরু করলেও লাভ হওয়ায় বর্তমানে অন্তত ১০ বিঘা জমিতে বিশাল বাগান গড়ে তুলেছেন।
কথা হয় বাগানের শ্রমিক সাইদুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাগান পরিচর্যা, গাছে খুটি দেওয়া, মাল্টা তোলাসহ বাগানে বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে সংসারের খরচসহ ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি।
স্থানীয় আবু তাহের নামের একজন বলেন, মাল্টা চাষে চমক দেখিয়েছেন শিক্ষক কাজিম উদ্দিন। তার সফলতা দেখতে বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। নতুন মাল্টা বাগান করা লোকজন কাজিম উদ্দিনকে তাদের আইডল মনে করেন।
শিক্ষক ও সফল কৃষি উদ্যোক্তা কাজিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, মাল্টার চারা লাগনোর প্রথম বছরেই লাভের মুখ দেখি। অল্প খরচে বেশি লাভবান হওয়ায় বেশি পরিমাণ জমিতে বেশি চারা রোপন করতে থাকি। এতে লাভের পরিমাণও বাড়তে থাকে। গতবছর ৫ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করলেও এবার মাল্টার বাম্পার ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় বিক্রি ৭ লাখ ছাড়াবে বলে মনে হচ্ছে।
কাজিম উদ্দিন বলেন, বাজারে বর্তমানে এক কেজি আমদানি করা বিদেশি মাল্টা কিনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে। আমার বাগানে উৎপাদিত মাল্টা প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে ব্যাপকভাবে মাল্টা চাষ হলে আমদানি নির্ভরতা কমবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি ১০ হাজার টন কমেছে। গত অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। এসব ফল কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয়েছে মাল্টা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজিয়া তাবাসসুম বলেন, দেশে কৃষকসহ বেকার যুবকরাও মাল্টা চাষ করছে। কিন্তু সে তুলনায় দেশে উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বাড়ানো যাচ্ছে না। চাহিদা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে উৎপাদন বাড়বে এবং আমদানি কমবে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরর ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু বলেন, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাল্টার আবাদ হয় ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট ও ত্রিশাল উপজেলায়। গতবছরের চেয়ে এবছর আবাদ বেড়েছে ৫০ হেক্টরের বেশি। এবছর ৩৭৪.৪ হেক্টর জমিতে মাল্টার আবাদ হয়েছে।
পুষ্টিগুণ সম্বৃদ্ধ মাল্টার চাষ বাড়াতে চাষীদের পরামর্শসহ সবধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন ড. নাছরিন আক্তার বানু।
মন্তব্য করুন