কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুরে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন সাদী মসজিদ। এখনো এটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এক সভ্যতার ইতিহাস-ঐতিহ্য আরেকটি সভ্যতার কাছে তুলে ধরছে স্থাপনা। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর গবেষণার জন্য এ স্থাপত্য অনেক গুরুত্ব বহন করে চলছে।
প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কয়েকশ বছরের এ মসজিদ। এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে দর্শনার্থীসহ গবেষকেরা প্রায়ই এখানে আসেন। উপজেলার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া-কাপাসিয়া সড়কের পাশে এগারসিন্দুর ইউনিয়নে বীর ঈশাখাঁর দুর্গের পাশেই সাদী মসজিদটি অবস্থিত।
সাড়ে তিন’শ বছরের পুরাতন মসজিদটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্ব-গৌরবে। লাল মাটির আকা-বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে সবুজ শ্যামল গাছগাছালি ঘেরা প্রকৃতির ভেতর চোখ ধাঁধানো প্রাচীন মসজিদ। সাথেই বিলে চকচকে সাদা পানি প্রবাহমান। প্রকৃতির এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি। প্রকৃতির অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত মসজিদটি যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ মসজিদটি সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৪২ সালে নির্মিত হয়। পোড়ামাটির অলংকরণে সমৃদ্ধ এ মসজিদটি সম্পূর্ণ ইটের তৈরি। এটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতি মসজিদ। প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট। চারপাশে চারটি বুরুজ আছে। পূর্ব দেয়ালে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। প্রবেশ পথগুলোর চারদিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের কাজ রয়েছে। ভেতরে ৩টি অনিন্দ্য সুন্দর মেহরাব রয়েছে যা টেরাকোটার দ্বারা অলংকৃত।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১০৬২ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে শাহজাহান বাদশা গাজীর রাজত্বকালে শেখ নিরুর পুত্র সাদীর উদ্যোগে এ মসজিদটি নির্মিত হয় বিধায় মসজিদটির নামকরণ করা হয় সাদী মসজিদ। এ মসজিদে একটি শিলালিপিতে আরবি ও ফারসি ভাষায় যা লিখা আছে তার বঙ্গানুবাদ হলো; ‘মহান আল্লাহ ব্যতিত আর কোন উপাস্য নাই। মোহাম্মদ আল্লাহর বাণীই জগতে প্রচার করেছেন। যিনি মহান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও ঈমান রাখেন তিনি একটি করে মসজিদ নির্মাণ করেন। যিনি পৃথিবীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে ৬০টি মসজিদ প্রস্তুত রাখেন।’
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নীরুর পুত্র সাদীর তত্বাবধানে শাহজাহান বাদশা গাজীর রাজত্বের সময় এই মসজিদ নির্মিত হল। হিজরী অব্দ ১০৬২, রবিউল আওয়াল।
সরেজমিন দেখা গেছে, এ মসজিদ অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। কোলাহলমুক্ত এর চারপাশ। মসজিদটির পাশে বয়ে গেছে বিশাল খাল। লাল মাটি, খালের অপূর্ব জলরাশি মসজিদের পরিবেশটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে। অপূর্ব সুন্দর এ মসজিদ দেখে যে কারো মন তৃপ্ত হবে।
হিরণ মিয়া নামে এক দর্শনার্থী বলেন, লোকমুখে এ পুরোনো মসজিদের কথা শুনেছি। আজ দেখতে এলাম। খুবই চমৎকার লাগছে। এটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। দেখে মন ভরে গেল।
স্থানীয় আবুল ফজল মিয়া বলেন, এই মসজিদে আমার বাপ-দাদা নামাজ পড়তেন। আমিও ৭০ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়ছি। ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদে নামাজ পড়লে মনে শান্তি পাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে দেখতে পারে তার জন্য এটি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।
তাড়াইল থেকে ঘুরতে আসা শহীদুল ইসলাম নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর ঘুরে দেখতে এসেছি। এখানকার দুটি প্রাচীন মসজিদ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বহু পুরাতন এসব মসজিদের স্থাপনা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি।
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, মসজিদটির ইতিহাস উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ আছে। পর্যটক ও দর্শনার্থীদের উৎসাহিত করতে উপজেলার প্রবেশমুখে বিলবোর্ডের মাধ্যমে এসব স্থাপত্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উপপরিচালক রাখী রায় বলেন, প্রাচীন এসব স্থাপত্যশৈলীর সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হয়। আমাদের পরিদর্শক দল নিয়মিত এসব স্থাপত্য পরিদর্শন করে। প্রাচীন এ মসজিদের অবয়ব যাতে নষ্ট না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন