ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একে একেবারে নির্মূল করা যায় না। তবে কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চললে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ রোগটির সঙ্গে কিছু কুসংস্কার জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যা একেবারেই অমূলক। যেমন-
▶ ডায়াবেটিস রোগীর সংস্পর্শে এলে আপনারও এ রোগ হবে : এটা সঠিক নয়। কারণ এটি ফ্লু বা জন্ডিসের মতো কোনো ভাইরাসজনিত রোগ নয়। এ কারণে পরিবারে কারও ডায়াবেটিস হলে অন্যদের এ রোগ হয় না। কারণ ডায়াবেটিস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
▶ বেশি চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয় : চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয় না। তবে ডায়াবেটিস হলে চিনি খাওয়া বারণ। যেহেতু বংশগত ও পরিবেশগত কারণে ডায়াবেটিস টাইপ-২ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, সে কারণে অনেক বেশি চিনি খেলে ওজন বাড়তে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও নিয়মিত ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
▶ টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলো সামান্য ডায়াবেটিস : সামান্য বা বর্ডার লাইন ডায়াবেটিস বলে কিছুই নেই। সব ধরনের ডায়াবেটিসই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পরিবারের কারও টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন নির্ভরশীল নয়, এমন ডায়াবেটিস হলে বুঝতে হবে রক্ত সম্পর্কিত সবাই ঝুঁকির মধ্যে আছে। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ প্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে কয়েকটি বিষয় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন- বেশি ওজন, ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স হলে, এশিয়ান অথবা আফ্রিকান হলে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বা গ্যাসটেশনাল ডায়াবেটিস থাকলে।
▶ ডায়াবেটিস থাকলে শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যায় : যদিও ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলোর অন্যতম হলো অন্ধত্ব। অর্থাৎ অন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে ডায়াবেটিসকে দায়ী করা হয়। তবে গবেষণায় কয়েকটি বিষয়ে প্রমাণিত হয়েছে, যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, স্বাভাবিক শারীরিক কাজকর্ম চালানো যায়, দেহের ওজন আদর্শ মাত্রায় রাখা যায়, ধূমপান থেকে বিরত থাকা যায়, তাহলে ডায়াবেটিস নিয়েও চোখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
▶ রোগীরা খেলাধুলা করতে পারবে না : ডায়াবেটিস রোগীদের নিজেদের কর্মক্ষম রাখার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের লক্ষ্যে ব্যায়াম করতে উৎসাহ দেওয়া হয়। ব্যায়াম ও খেলাধুলা অনেকটাই সমার্থক। এগুলো ডায়াবেটিসকে যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখে তেমনি হৃদরোগ এড়াতেও সাহায্য করে। ইনসুলিন বা ট্যাবলেট গ্রহণ করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানোর জন্য ভারী ব্যায়াম বা দীর্ঘক্ষণ ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই। তবে যদি খেলাধুলা বা ভারী ব্যায়াম করতে হয় সেক্ষেত্রে ইসনুলিনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে উচ্চ শর্করাযুক্ত খাবার খেতে হবে বা সঙ্গে রাখতে হবে।
▶ ডায়াবেটিস রোগীদের সর্দি-কাশি ও অন্যান্য রোগ বেশি হয় : ডায়াবেটিস থাকলেই আপনার ঘন ঘন সর্দি-কাশি অথবা অন্যান্য রোগ বেশি হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে যে কোনো সংক্রমণ রক্তে শর্করার ওপর হস্তক্ষেপ করে থাকে। এজন্য সতর্কতার প্রয়োজন বিশেষ করে টাইপ-১ বা ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ক্ষেত্রে। এদের কিটো এসিডোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং দেহে ক্ষতিকর কিটোন বডি উৎপন্ন হয়।
▶ ডায়াবেটিস থাকলে খুব কম পরিমাণে শর্করাযুক্ত খাবার খেতে হয় : এটা ঠিক নয়। শর্করাযুক্ত খাবার হলো ভাত-রুটি-চিড়া-মুড়ি-খই-আলু-পাস্তা ইত্যাদি। এ খাবারগুলো চাহিদা অনুযায়ী খেতে হয়। কম নয় আবার বেশিও নয়। কারণ এগুলো রক্তে শর্করার ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। শর্করা কম হলে ওজন কমে যায় ও রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় নিচে নেমে যায়। যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। আবার বেশি হলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এজন্য প্রয়োজন মতো শর্করাযুক্ত খাবার খাওয়া দরকার।
▶ ডায়াবেটিস রোগীদের বিশেষ ডায়াবেটিক খাবার খেতে হয় : ডায়াবেটিস রোগীদের অন্যদের মতো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। যাতে থাকবে কম চর্বি, কম লবণ ও চিনিবর্জিত। বিকল্প চিনি দিয়ে যেসব খাবার তৈরি হয়, সেগুলো অনেকসময় কোনো উপকারে আসে না। বরং কোনো কোনো সময় এগুলোতে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়। যেমন-বিকল্প চিনি দিয়ে তৈরি পায়েস। এতে ঘন দুধের প্রয়োজন হয়। যা ল্যাক্টোজের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। আবার এ ধরনের খাবারের দাম বেশি ও ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে বলে এগুলো না খাওয়াই ভালো।
▶ টক জাতীয় খাবার খেলে রক্তে শর্করা কমে যায় : একেবারেই ভুল ধারণা। অনেকে মনে করেন যেহেতু ডায়াবেটিসে চিনি খাওয়া বারণ এবং টক খেতে কোনো বাধা নেই। তাহলে ডায়াবেটিস কমাতে টকই আদর্শ। আসলে টকের মধ্যে এমন কোনো উপাদান নেই, যাতে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাবে। বরং কোনো কোনো টক ফলে শর্করার মাত্রা বেশি থাকে।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।
মন্তব্য করুন