স্বপ্ন ছিল স্টুডেন্ট ভিসায় জাপান যাবে ফয়সাল সরকার। এজন্য অনেক চেষ্টা- সাধনা করে জাপানি ভাষাও শিখেছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পরই স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাবে, এমনটি ঠিক করেছি। এজন্য আনুসঙ্গিক সকল কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু ঘাতকের প্রাণঘাতী বুলেট ফয়সালের সকল স্বপ্ন কেড়ে নেয়।
২০২৪ সালে ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার খুনি বাহিনীর প্রাণঘাতী গুলিতে শহীদ হয়ে অকালে পরপারে পাড়ি জমান সেই স্বপ্নবাজ তরুণ ফয়সাল। ওইদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় ফয়সাল। ১৯ জুলাই শহীদ হলেও পরিবারের লোকজন ১ আগস্ট জানতে পারেন, ফয়সালকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
ফয়সাল রাজধানীর দক্ষিণখান এস এম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তার মৃত্যুর তিন মাস পর রেজাল্ট প্রকাশ হলে জানা যায়, ফয়সাল জিপিএ-৪.৩৫ পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এই খবরে উচ্ছ্বাসের বদলে বিষাদের ছায়া নেমে আসে ফয়সালের পরিবার, সহপাঠী ও স্বজনদের মধ্যে।
কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের মো. সফিকুল ইসলাম সরকার (৭৫) ও হাজেরা বেগমের (৬০) সপ্তম সন্তান ফয়সাল সরকার। আট ভাই-বোনের মধ্যে ফয়সাল ছিলেন সপ্তম। ছয় মেয়ের পর ফয়সালের জন্ম হওয়ায় পরিবারের সকলের পরম আদরে-স্নেহে বড় হয়েছে সে।
বড় বোনদের সকলের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে ফয়সালের ওপর। ফয়সালের বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সংসারের অভাব ঘোচাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপাইভাইজারের কাজ নেয় সে।
সম্প্রতি ফয়সালের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে তার মা, বাবা ও ছোট ভাই ফাহাদ সরকার সাথে কথা হয় জাতীয় বার্তা সংস্থা, বাসস-এর প্রতিবেদকের।
ফয়সাল সরকারের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার জানান, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকালে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয় আমার ভাই। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি শুরু করি।’
তিনি জানান, ‘১২ দিন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুজি করেও কোথাও কোনো সন্ধান মেলেনি। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় জিডি করি। পরে আগস্টের এক তারিখ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিই। তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখান। সেখানে ভাইয়ের মরদেহের ছবি দেখতে পাই।’
শহীদ ফয়সালের বাবা সফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘সংসারের অভাব ঘোচাতে ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম কাজ করত। এখন আমার পুরো সংসার সংকটে পড়ে গেছে। আমার ছেলে রাজনীতি করত না। আমার ছেলেকে কেনো খুন করল ওরা? আমার ছেলের কী দোষ ছিল? আমি আমার ছেলের খুনিদের বিচার চাই।’
ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ আরও বলেন, ‘ভাই আমাদের সংসার চালাত। এখন আমাদের দেখার মতো কেউ নেই। আমি ঢাকায় কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ভাইয়ের মৃত্যুর পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা সবাই ঢাকার বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি।’
ছেলের লাশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফয়সালের মা হাজেরা বেগম বলেন, ‘ফয়সালের লাশ আমরা পাইনি। অনেক জায়গায় খোঁজাখুজি করেও পাইনি। পরে জানলাম, রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। আমার ছেলের কবর কোনটা এটাও জানতে পারলাম না।’
এরপর কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সালকে ডাক দিমু তাও পারমু না। ফয়সাল বাবা কই গিয়া শুইয়া আছত! আমার পোলা কতদিন আমারে মা কইয়া ডাকে না। আমার বুকে আয় বাবা, আমি তরে জড়াইয়া ধরি!’
ফয়সালের ভাই জানান, সাহায্য হিসেবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহর মাধ্যমে ২ লাখ এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন।
শহীদ ফয়সালের বাবা সফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বয়স হয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থ। ফয়সালের মায়ের অবস্থাও ভালো না। পরিবারে উপার্জন করত একমাত্র ফয়সাল। সংসার চলত ওর আয় দিয়েই। সরকারের কাছে আমার ছোট ছেলেকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানাই, যাতে আমরা মোটামুটি খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।
মন্তব্য করুন